Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

রানাঘাটে ৭৬৩ বছরের ঐতিহ্য : ‘বুড়ো মা’-র পুজোয় আজও মেলে মনোবাসনা পূরণের আশীর্বাদ

 

Worship-of-Buro-Maa

সমকালীন প্রতিবেদন : ‌নদিয়ার রানাঘাটে প্রতি বছর শরৎ আসলেই যেন সময় থমকে দাঁড়ায় ৭৬৩ বছরের এক অবিচ্ছিন্ন ঐতিহ্যের সামনে। এখানে মা দুর্গা পূজিত হন ‘বুড়ো মা’ নামে — এবং এ পুজোর সূচনা কোনও শতাব্দী দুয়েক আগে নয়, খ্রিষ্টাব্দ ১২৬২ সালে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে আজও সেই প্রাচীন পুজো একই আচার ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়, আর ভক্তদের মুখে মুখে ফেরে দেবীর মাহাত্ম্যের নানা কাহিনি।

শোনা যায়, ১২৬২ খ্রিষ্টাব্দে মায়ের একনিষ্ঠ সাধক রামকুমার চক্রবর্তী পদব্রজে রাঢ়বঙ্গ ভ্রমণ শেষে ফিরে আসার পথে আজকের রানাঘাটের ব্রহ্মডাঙায় পৌঁছে শরতের আগমন অনুভব করেন। ঠিক সেই সময়ই তিনি দেবী দুর্গার স্বপ্নাদেশ পান পুজো আয়োজনের জন্য। দেবীর আদেশ মান্য করে তিনি আশেপাশের পাঁচটি বাড়ি থেকে ভিক্ষা সংগ্রহ করে শুরু করেন পুজো। সেই বিনম্র সূচনাই আজ বহুকাল পরে এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

সাধক রামকুমার নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর পালিতা কন্যার দুই মেয়ের মধ্যে একজনের বিবাহ হয় মুখোপাধ্যায় পরিবারে। সেই পরিবারের বংশধররাই আজও ‘বুড়ো মা’-র পুজোর দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

এই পুজোর মাহাত্ম্য একসময় পৌঁছে যায় নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কানে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, দেবী নাকি নিজে উপস্থিত হয়ে পুজো গ্রহণ করেন — এ কথা শুনে রাজা সত্যতা যাচাই করতে চান। তিনি প্রতিমার একটি আঙুল কেটে পরীক্ষা করেন, আর তখনই প্রতিমা থেকে ঝরতে থাকে রক্ত! দেবীর ঐশ্বরিক শক্তি প্রত্যক্ষ করে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং পুজোর জন্য অর্থসাহায্য প্রদান করেন। সেই সঙ্গে মুখোপাধ্যায় পরিবারকে ‘শর্মা চৌধুরী’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

এই পুজোর সূচনা হয় উল্টোরথের দিন, যখন পাটে সিঁদুর মেখে শুরু হয় প্রতিমা নির্মাণ। চতুর্থীতে প্রতিমা বসানো হয় পাটে, পঞ্চমীতে দেবীকে পরানো হয় গয়না, আর ষষ্ঠী থেকে শুরু হয় মূল পুজো। প্রতিদিনই নিবেদিত হয় নানা ভোগ। অষ্টমী ও নবমীতে পুষ্পাঞ্জলির জন্য ভিড় জমে জনসমুদ্রের মতো।

বিশেষ আকর্ষণ ‘ধুনো পোড়ানো’। দেবীর কৃপায় যাঁদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে, তাঁরা এই আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেন। দূরদূরান্ত থেকে বহু ভক্ত আসেন শুধুমাত্র এই ধুনো পোড়ানো দেখার জন্য।

পুজো হয় একটি প্রাচীন তালপাতার পুঁথি অনুসারে, যার বয়স অন্তত ৩৫০ বছরের বেশি। এটি একটি মূল পুঁথির অনুলিপি, মূলটি দুর্ভাগ্যবশত আর নেই। পুরাণ গবেষক ড. শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এর লিপি ও লেখার ধরন থেকেই বোঝা যায় এটি মধ্যযুগীয় বাংলা লিপির ঐতিহ্য বহন করে।

আজও দেশ-বিদেশ থেকে ভক্তরা আসেন রানাঘাটে ‘বুড়ো মা’-র দর্শনে। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, এই দেবী পূর্ণ করেন মনের সমস্ত কামনা। সাত শতকেরও বেশি পুরনো এই পুজো আজও একই শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে পালন করা হয়, যেন সময়ের স্রোত থেমে গেছে এই ঐতিহ্যের সামনে।‌



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন