সমকালীন প্রতিবেদন : ‘সেফ হেভেন’—এই দুটি শব্দ আজকাল বিনিয়োগের পরিসরে এক অচলায়তন। আর এই নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতীক হল সোনা। ইতিহাসে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে যে, শেয়ার বাজারের টালমাটাল পরিস্থিতিতে লগ্নিকারীদের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে এই হলুদ ধাতু। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু নিরাপদ নয়, সোনায় বিনিয়োগ অত্যন্ত লাভজনকও।
২০১৯ সালের মে মাসে প্রতি ১০ গ্রাম ২৪ ক্যারাট সোনার দাম ছিল প্রায় ৩২,০০০ টাকা। আর ২০২৫ সালের মে মাসে সেই দাম পৌঁছায় ৯৭,৮০০ টাকায়। অর্থাৎ মাত্র ছ’বছরে প্রায় ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি। এমনকি এই সময়ের মধ্যে একাধিকবার ১০ গ্রাম সোনার দাম ১ লক্ষ টাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে। এই বৃদ্ধি ছাপিয়ে গিয়েছে সেনসেক্স, নিফটি ৫০-র মতো বেঞ্চমার্ক সূচকগুলিকেও। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালে সেনসেক্স বেড়েছে মাত্র ৩.৭৫ শতাংশ এবং নিফটি ৫০ ৪.৬৫ শতাংশ, যেখানে রিলায়েন্স বা এইচডিএফসি ব্যাঙ্কের মতো প্রতিষ্ঠিত সংস্থার স্টকও দিয়েছে ১২-১৪ শতাংশ রিটার্ন। কিন্তু সেই তুলনায় সোনার রিটার্ন ৩০ শতাংশের বেশি।
শুধু সোনাই নয়, এই সময়ের মধ্যে রুপোর দামও আকাশছোঁয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছে রুপো। সোনা ও রুপোর সমান্তরাল উত্থান বুঝিয়ে দিচ্ছে, ধাতুতে বিনিয়োগে আগ্রহ বাড়ছে লগ্নিকারীদের মধ্যে। সোনার দামের এই বিপুল উত্থানের পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ একাধিক ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ।
সেই কারণগুলি হল– রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, ২০২৩ সালে আমেরিকান ব্যাঙ্কিং সেক্টরে ধস, চীনের সঙ্গে আমেরিকার ট্যারিফ যুদ্ধ, বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির সোনায় লগ্নি বাড়ানো এবং ডলারের নির্ভরতা কমানোর আন্তর্জাতিক প্রবণতা। এই ধরনের ঘটনাগুলি শেয়ার বাজারে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। আর এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্প হিসেবে ঝুঁকেছেন সোনার দিকে। এর পাশাপাশি, ভারতের মতো দেশে উৎসব, বিয়ে ও পারিবারিক আচার অনুষ্ঠানে সোনার সামাজিক গুরুত্ব দাম বৃদ্ধিতে ইন্ধন জুগিয়েছে।
বাজার বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ২০২৫ সালের মধ্যেই সোনার দাম পৌঁছাতে পারে ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকায়। তাঁর মতে, এই প্রবণতা আগামী পাঁচ বছরেও বজায় থাকবে। তাঁরা আরও বলেছেন— "২০২৯ বা ২০৩০ নাগাদ প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দাম পৌঁছাতে পারে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকায়।" এই মতের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন আরও অনেক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে, “সোনার প্রতি আগ্রহ এখনও তুঙ্গে। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলির সোনা কেনার প্রবণতা বজায় থাকলে দাম আরও বাড়বে।”
বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে, বিশেষজ্ঞদের মত— সোনার বিনিয়োগে দীর্ঘমেয়াদী লাভের সম্ভাবনা প্রবল। যারা রিটার্ন ও নিরাপত্তা—দু’টি একসঙ্গে চান, তাঁদের জন্য গোল্ড ইটিএফ, সোনার বন্ড, ডিজিটাল গোল্ড বা ফিজিক্যাল গোল্ড আদর্শ বিকল্প হতে পারে। ভবিষ্যতের ব্যয়ের কথা ভেবে সোনায় ধাপে ধাপে লগ্নি করার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেক অর্থনীতিবিদ।
ভারতের মতো দেশে সোনা কখনও শুধুই ধাতু নয়—এ এক আর্থিক সুরক্ষা, সামাজিক মর্যাদা এবং প্রজন্মান্তরে সম্পদ সংরক্ষণের প্রতীক। গত ছয় বছরে যার জ্যোতি আরও উজ্জ্বল হয়েছে লাভের হিসেবে। আর বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস যদি সত্যি হয়, তবে আগামী পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীদের ঝুলিতে যুক্ত হতে চলেছে আরও সোনালি সাফল্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন