বাংলা মাধ্যম স্কুলে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ
অজয় মজুমদার
প্রায় কুড়ি বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছাত্র সংখ্যা কমে যাচ্ছে কলকাতা অঞ্চলে। আমরা যখন প্র্যাকটিস টিচিং করতাম, তখন দেখেছি বেশ কিছু বাংলা মাধ্যম স্কুলের দুরবস্থা। তার বিশ্লেষণ এবং আজকের বিশ্লেষণ মিলে যে বিষয়গুলি ধরা পড়েছে, সেগুলি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
বাংলা মাধ্যম স্কুল গ্রামাঞ্চলে খুব সুন্দরভাবে চলতো৷ যদিও একদম নিচু ক্লাস থেকে ইংরেজি না পড়াবার বিষয়ে একটু ক্ষোভ ছিল৷ তবুও সাধারণ মানুষের গতিও ছিল না ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাওয়ার। তাই বাধ্য হয়েই খানিকটা তাঁরা বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়মুখী হতেন।
আজকে বেশ কিছু মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার জন্য, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য এবং পরিষেবা বাড়ার জন্য ইংলিশ মিডিয়ামে ছাত্র সংখ্যা অনেক বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের নিকটবর্তী একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। মহকুমার কোনও সরকারি স্কুলের ছাত্র সংখ্যা এর ধারেকাছেও যাবে না৷
কেন এইরকম হাল হলো বাংলা মিডিয়াম স্কুলের ? না পড়ার কারণগুলি আমার যেটা মনে হয় সেটা হল, সিলেবাসের মধ্যে প্রজেক্ট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রোজেক্টের কাজগুলি স্বচ্ছভাবে হচ্ছে না। এই প্রজেক্ট থেকে পূর্ণ সংখ্যায় নম্বর দেওয়ার প্রবণতা ছাত্রদের কোয়ালিটি কমিয়ে দিয়েছে। ভুরিভুরি নম্বর পাওয়া যাচ্ছে। অঙ্কের মতো বিষয় জোড়াতালি দিয়ে প্রায় কিছু না শিখেই পাশ করে যাচ্ছে।
সেইজন্য ৯০ শতাংশ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীও অংক নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তে চাইছে না। কেন সে ভয় পাচ্ছে? এর কারণগুলি তো বিশ্লেষণ হওয়া খুবই প্রয়োজন। ভালমন্দের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। কারণে-অকারণে বিদ্যালয়ে যে পরিমাণ ছুটি থাকে, সে কথা তো সবারই জানা। অভিভাবকদের কাছে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরী হয়েছে।
উপস্থিতির উপর কোনওকিছু নির্ভর করে না। ছাত্র কোথায় গেল, নাগেলে তার ওপর কোনও মূল্যায়ন হয় না। ছাত্রদের বিনা কারণে অমনোযোগী না হত্তয়ার কোনও প্রচেষ্টা বিদ্যালয়ের নেই৷
অথচ প্রত্যেকটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মধ্যেই রয়েছে ছাত্রের পৃথক পৃথক সমীক্ষা এবং ব্যবস্থাপন। উপস্থিতির উপর ভীষণ কড়াকড়ি৷ ছাত্রের প্রতি যত্নবান, অভিভাবককে ডাকা এবং ছাত্রের ত্রুটিগুলি সম্পর্কে তাদেরকে ওয়াকিবহাল করানো।
এক কথায় ছাত্রদের প্রতি কেয়ার বা যত্ন নেওয়া হয়। সেগুলি বাংলা মাধ্যম স্কুলে একেবারেই হয় না। আগে শিক্ষকদের মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল, বর্তমানে সেসব আন্তরিকতা ধুলোয় মিশে গেছে। কারণ বর্তমান শিক্ষকেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছেন৷ আগামী প্রজন্মের এই জাতীয় স্কুল থাকবে কিনা ? তাদের দুশ্চিন্তাও গ্রাস করে ফেলেছে৷
সবমিলিয়ে নতুন করে ভাববার দিন এসেছে। বাংলা মিডিয়াম স্কুল চলবে কিনা, চলতে গেলে পাঠ্যসূচী যুগ উপযোগী করা, অনেক বেশি প্র্যাকটিক্যাল ওরিয়েন্টেড করা, অনেক বেশি ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তৈরি করা, অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, মাতৃভাষা ছাড়াও ইংরেজি এবং হিন্দিতে কথোপকথনে পারদর্শী করে তোলা, বিদ্যালয়ে স্পোকেন ইংলিশ এবং স্পোকেন হিন্দি শেখানো একান্ত প্রয়োজন৷
শিক্ষকদের সুচিন্তিত মতামত এক্ষেত্রে খুব জরুরী৷ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকদের স্বল্প বেতন পাওয়া সত্ত্বেও, এতোটা ছাত্রমুখী হওয়ার কারণটা সবাইকে অবাক করে। প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এবং নিদারুণ চাপ, যেটি সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলিতে একেবারেই হয়না৷ প্রধান শিক্ষককে না মানার প্রবণতা, প্রধান শিক্ষককে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা, বিদ্যালয়ে কমিটির মধ্যে শিক্ষামনস্ক মানুষের প্রবেশ অধিকার নেই, সেজন্যই শিক্ষার দুরবস্থা বলে মনে করি৷
দিনের পর দিন এইরকম উদাসিন ভাব কি শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না? ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে অর্থকরী বেসরকারি ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
এই অবস্থায় পিছিয়ে পড়া নিম্ন অর্থনৈতিক ঘরের ছেলেমেয়েরা উঠে আসার প্রবণতা একেবারেই থাকবে না। ওয়েলফেয়ার কান্ট্রিতে যে ব্যবস্থাপনা হওয়া উচিত, তা কিন্তু ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে ৷ সবকিছুর মধ্যেই একটা লাভজনক হাতছানি দেখা হচ্ছে।
খুব ভালো লেখা।খুব প্রয়োজনীয় বিষয়। শিক্ষার সঙ্গে জড়িত সকলেই যদি এরকম দায়বোধ নিয়ে কাজটা করে, তাহলে মিডিয়াম কোনো বিষয় হয়ে ওঠে না।শিক্ষার গুণমান আসল ।সেটা নেই বলেই বাংলা মিডিয়ামে ছাত্র কম।যথার্থই লিখেছেন । লেখককে ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন