Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

শুক্রবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

রোহিঙ্গা শরনার্থী কেন ? (‌পর্ব-১২)‌

 ‌

Why-Rohingya-refugees-Episode-12

রোহিঙ্গা শরনার্থী কেন ? (‌পর্ব-১২)‌

অজয় মজুমদার

রোহিঙ্গার ভাষার জন্য বাঙালীদের থেকে এতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। দুর্বোধ্য মাতৃভাষা 'রোহিঙ্গালিস'। রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র নিজস্ব ভাষার বাইরে কিছুই বোঝে না। রোহিঙ্গাদের শিবিরের আর্তনাদ, যন্ত্রণা, হাসি-কান্না আর বৈপ্লবিক জিহাদ– সবটাই দুর্বোধ্য উচ্চারণ ৷ অনেক চেষ্টা করে দু'একটি কথা লিখলেও তাই হিমশৈলের চূড়ার কনা মাত্র। তবুও কিছুটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ রোহিঙ্গা কথার মধ্যে মিলেমিশে ছিল বলে মাতৃভাষার টান সত্বেও কান্নার অনুরণন বোঝা খুব কঠিন ৷


খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতাব্দীতে আরাকান রাষ্ট্রে 'রোহান' অথবা 'রোহাঙ' নামে পরিচিত ছিলেন বর্তমানে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বাসিন্দারা। দেশের পশ্চিম অঞ্চলের ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের পাদদেশে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ই হল 'রোহিঙ্গা'। রাষ্ট্রহীন জাতি রোহিঙ্গাদের ভাষাটা কোনও ব্যাকরণ মেনে  হয়নি। আরবি লিপিতে লেখা রোহিঙ্গা ভাষা দু'শো বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে ৷ ব্রিটিশ শাসনের সময় আদর্শ (১৮২৬ থেকে ১৯৪৮) রোহিঙ্গাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ইংরেজি ও উর্দু। 


১৯৪৮ সালে বার্মা (‌বর্তমান মায়ানমার)‌ স্বাধীন হওয়ার পর সমস্ত সরকারি দপ্তরে বার্মি ভাষা চালু হয়। স্বভাবতই ছয়ের দশকে রোহিঙ্গা শিক্ষাবিদরা তাঁদের ভাষার সঙ্গে মানানসই লিখন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে ১৯৭৫ সালে আরবি অক্ষর ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা নিজেদের লিখন পদ্ধতি চালু করেন। পরে এই অক্ষরের অনেক দোষ ত্রুটি দেখা দেওয়ায় উর্দুলিপিত্ত মিশিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে আরবি অক্ষরের উপর ভিত্তি করেই 'রোহিঙ্গা ইউনিকোড' তৈরির চেষ্টা চলছিল ৷ 

প্রকৃতপক্ষে উর্দু ,হানিফ, বার্মি ও লাতিন লিপি ব্যবহার করে একটা 'জগা খিচুড়ী' ভাষা চালু হয়েছে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ৷ যা বৃটিশ মিউজিয়ামের স্বীকৃতি পেয়েছে 'রোহিঙ্গালিস' নামে ৷ বাংলা ভাষার একটা বর্ণও রোহিঙ্গা লিপিতে ঠাঁই পায়নি।         

কক্সবাজার রাজু কলেজের অধ্যাপক ও গবেষক ক্য থিং আং তাঁর 'লুণ্ঠিত সভ্যতা' বইতে রোহিঙ্গা জীবন, ভাষা ও সংস্কৃতির যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে এই বইটি প্রমান্য দলিল হয়ে  উঠেছে অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য ৷ রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ধ্যার আসরে যে গান শোনা যায়, তা বাংলার নৌকার মাঝিমাল্লার দাঁড়টানার সময়ের মুখের গানের সঙ্গে তুলনীয় ।

'ওলে মারো 

য়ি লে রিলে 

রিলে রিলে.......'

জনৈক গবেষক শঙ্করের অনুবাদে-

 'এই যে সাথি ভাই গন 

 জোরে মারো হেঁইও টান ,

জোরে মারো হেঁইও টান 

এই যে সাথি ভাইগণ ৷'‌

বাঙালি, মোগল, বৌদ্ধ ও আরাকানের সংস্কৃতির সঙ্গে আরব নৌবণিকদের পাশাপাশি জলদস্যুদের রক্ত মিশে আছে রোহিঙ্গাদের শরীরে ৷ তাই রোহিঙ্গা ভাষাতেও ইউরোপীয় মধ্য এশিয়া ও আরবি শব্দের উচ্চারণ ৷ মৌলানা হানিফ এবং তাঁর সহকর্মীরা আরবি বর্ণমালার সঙ্গে কিছু রোমান ও বার্মি অক্ষর যুক্ত করে একসময় নয়া লিখন পদ্ধতি চালু করেছিলেন ৷ ইসলামিক শিক্ষাবিদরা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেন ৷ অক্ষরগুলি স্মৃতিকে প্রভাব না ফেলায় সমালোচিত হয় ৷ এসব সত্ত্বেও এখনও হানিফি বর্ণমালাকে মাধ্যম করেই ভাষা শিক্ষা চলছে। 

বাংলাদেশের ভাষাবিদ ও গবেষক ই.এম সিদ্দিক শুধুমাত্র লাতিন অক্ষর ব্যবহার করে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতির লিখন ধারা প্রচলন করেন ৷ এই ভাষাটি 'রোহিঙ্গালিস' নামে প্রতিবেশী গবেষকদের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছে ৷ সিদ্দিকীর এই ভাষায় ২৬ টি রোমান হরফ রয়েছে। এটাই এখন রোহিঙ্গা ভাষা গবেষণার অন্যতম অবলম্বন ৷     

তাহলে বোঝা যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মাতৃভাষা জীবনের প্রথম থেকেই খটমট এবং অবহেলিত ৷ বিদ্যাসাগরের অক্ষরগুলি চাটগাঁই বাঙালি হয়েও একবিন্দুও গ্রহণ করতে পারেনি ৷ এদের জীবনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শুধুই বঞ্চনা ছাড়া আর কি? ভাষা এত জটিল ও দুর্বোধ্য হওয়ায় সাক্ষরতা জ্ঞান বেশিরভাগ রোহিঙ্গাদেরই হয়ে ওঠেনি ৷ আর যারা ভাষা সংগ্রামে জয়ী হয়েছে, তারা কিছুটা শিক্ষায় এগিয়েছে ৷ তবে সংখ্যায় ভীষণ কম।‌


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন