সমকালীন প্রতিবেদন : প্রকৃতির মাঝে শান্তি খুঁজতে চাইলে ঝাড়খন্ড হতে পারে এক আদর্শ গন্তব্য। পাহাড়, বন, ঝরনা আর মেঘে ঢাকা আকাশ—সব মিলিয়ে এই রাজ্য যেন ভারতের এক অপ্রকাশিত রত্নভাণ্ডার। রাজধানী রাঁচি থেকে শুরু করে নেতারহাট পাহাড়, শিমুলতলার নিরিবিলি বনাঞ্চল—সব জায়গাতেই প্রকৃতির মায়ায় ভরপুর অনাবিল শান্তি ও সৌন্দর্য।
‘সিটি অব ওয়াটারফলস’ নামে পরিচিত রাঁচি শহর ঝাড়খন্ড ভ্রমণের প্রধান কেন্দ্র। এখান থেকে অল্প দূরত্বেই ছড়িয়ে রয়েছে একাধিক মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় Hundru Falls-এর নাম। সুবর্ণরেখা নদীর উপর প্রায় ৯৮ মিটার উঁচু থেকে নামা এই জলপ্রপাত বর্ষাকালে হয়ে ওঠে দুর্দান্ত দর্শনীয়। রাঁচি থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জায়গা সহজেই গাড়ি বা ট্যাক্সিতে পৌঁছনো যায়।
এর পরেই Jonha Falls—রারু নদীর ধারে অবস্থিত এই ঝরনায় নামার আগে প্রায় ২০০টি ধাপ পেরোতে হয়। ঝরনার নিচের প্রাকৃতিক পাথরের বুকে দাঁড়িয়ে যে শীতলতার অনুভূতি পাওয়া যায়, তা সত্যিই অনন্য। রাঁচির আশেপাশে আরও রয়েছে Dassam Falls, Sita Falls, Hirni Falls—যেখানে প্রকৃতির কোলেই মিলবে নিরবতা আর রোমাঞ্চের মিশেল।
রাঁচি থেকে প্রায় ১৫৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নেতারহাটকে বলা হয় ‘কুইন অব চোটানাগপুর’ অর্থাৎ ঝাড়খন্ডের “রানী পাহাড়”। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য এতটাই মনোমুগ্ধকর যে, স্থানীয়রা একে “ন্যাচারাল ব্যালকনি অফ ঝাড়খন্ড” বলে আখ্যা দেন। নেতারহাটের অন্যতম আকর্ষণ Lower Ghaghri Falls—৯৮ মিটার উঁচু থেকে ঝরে পড়া এই জলধারা চারপাশের ঘন অরণ্যকে করে তোলে আরও রহস্যময়।
এছাড়া কাছেই রয়েছে Upper Ghaghri ও Magnolia Point, যেখানে সূর্যাস্তের সময় পাহাড়ে রঙের খেলা পর্যটকদের মুগ্ধ করে দেয়। নেতারহাটে সরকারি পর্যটন বাংলো, ইকো রিসোর্ট এবং ছোট গেস্টহাউসের মতো বেশ কিছু থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার রান্নায় স্থানীয় ছোঁয়া—ডাল-ভাত, ধুসকা, থেকুয়া—সবই প্রাকৃতিক আবহে উপভোগ্য।
ঝাড়খন্ড-বিহার সীমান্তের কাছাকাছি ছোট্ট পাহাড়ি অঞ্চল শিমুলতলা আজও কিছুটা অজানা পর্যটন রত্ন। বনভূমি ঘেরা এই এলাকা একসময় ‘স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া কেন্দ্র’ হিসেবে পরিচিত ছিল। আজও যারা ভিড় থেকে দূরে শান্ত প্রকৃতি খোঁজেন, তাঁদের জন্য শিমুলতলা আদর্শ গন্তব্য। এখানে ছোটখাটো ট্রেকিং, গ্রামীণ জীবন দেখা, পাখি দেখা বা স্থানীয় হোমস্টেতে রাত কাটানো—সব মিলিয়ে এটি প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক নির্ভেজাল অভিজ্ঞতা।
রাঁচি রেল বা বিমানে সহজেই পৌঁছনো যায়। সেখান থেকে ট্যাক্সি বা রেন্টাল কার নিয়ে জলপ্রপাত ঘোরা সবচেয়ে সুবিধাজনক। একটি আদর্শ তিন দিনের পরিকল্পনা হতে পারে—
প্রথম দিন: রাঁচিতে আগমন, Hundru ও Jonha Falls দর্শন, দ্বিতীয় দিন: রাঁচি থেকে নেতারহাট যাত্রা, Lower Ghaghri ও Magnolia Point পরিদর্শন, তৃতীয় দিন: ভোরে সূর্যোদয় দেখা, শিমুলতলা হয়ে রাঁচি প্রত্যাবর্তন। এখানে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো সময় অক্টোবর থেকে মার্চ—এই সময়ে আবহাওয়া মনোরম ও ভ্রমণ উপযোগী থাকে। বর্ষায় ঝরনাগুলির জলপ্রবাহ বেড়ে ওঠে বটে, তবে রাস্তা ও নিরাপত্তার দিকে বাড়তি নজর দিতে হয়।
রাঁচিতে রয়েছে নানা মানের হোটেল—₹৮০০ থেকে ₹৩০০০-এর মধ্যে। নেতারহাটে সরকারি পর্যটন বাংলো ও কিছু ইকো-রিসোর্টে থাকার সুযোগ আছে। শিমুলতলায় স্থানীয় হোমস্টে বা গেস্টহাউসই প্রধান ভরসা। খাবারে পাওয়া যায় ঝাড়খন্ডের ঐতিহ্যবাহী পদ—ধুসকা, পিঠা, চানা-ঝাল, থেকুয়া ইত্যাদি। রাঁচিতে আবার শহুরে রেস্তরাঁয় উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় খাদ্যও সহজলভ্য।
রাঁচির জলপ্রপাত, নেতারহাটের পাহাড় আর শিমুলতলার নীরবতা—সব মিলিয়ে ঝাড়খন্ড এমন এক গন্তব্য যেখানে প্রকৃতি, শান্তি ও রোমাঞ্চ একসাথে মেলে। ভিড়ভাট্টার শহুরে জীবন থেকে একটু বিরতি নিয়ে এই অরণ্য ও পাহাড়ের রাজ্যে কয়েকটা দিন কাটালে, মনে হবে—ভারতের আসল সৌন্দর্য এখনো এখানেই লুকিয়ে আছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন