সমকালীন প্রতিবেদন : গাইঘাটা থেকে শুরু করে গোটা জেলা তথা রাজ্য জুড়ে এখন একটাই প্রশ্ন— বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর কি সত্যিই তৃণমূলে যোগ দিতে চলেছেন? গাইঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক এবং মতুয়া মহাসংঘের মহাসংঘাধিপতি সুব্রত ঠাকুরের তৃণমূলে যোগদান নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির অভ্যন্তরে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সিএএকে ঘিরে মতুয়া কার্ড বিতরণ এবং ক্ষমতার লড়াই সর্বপরি শান্তনু ঠাকুরের দাবি এই জল্পনাকে আরও উসকে দিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দিরে বসানো বিশেষ ক্যাম্পকে ঘিরে। ওই ক্যাম্পে দেওয়া হচ্ছে সিএএ-সংক্রান্ত ‘মতুয়া কার্ড’ ও ‘হিন্দুত্ব কার্ড’। দাবি করা হচ্ছে, এই কার্ড দেখিয়েই পরবর্তীকালে সিএএ-র অধীনে নাগরিকত্বের সুবিধা পাওয়া যাবে। শতাধিক টেবিল বসিয়ে চলছে সেই কার্যক্রম। হাজার হাজার মতুয়া ভক্ত ঠাকুরবাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন কার্ড সংগ্রহের জন্য। শান্তনু এবং সুব্রত ঠাকুর ঠাকুরবাড়ির ভেতরেই আলাদা আলাদা এই ক্যাম্প চালাচ্ছেন।
গোলমালের শুরু যখন শান্তনু ঠাকুর ঠাকুরবাড়ির নাটমন্দিতে এই ক্যাম্প চালু করেন তখন। শান্তনুর দাদা তথা গাইঘাটার বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর অভিযোগ তুলেছেন, তাঁর ভাই তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর বেআইনিভাবে নাটমন্দিরে ক্যাম্প বসিয়েছেন। তাঁর কথায়—“নাটমন্দির সকল মতুয়া ভক্তদের জায়গা। রাজনৈতিক স্বার্থে সেখানে ক্যাম্প বসানো ঠিক নয়।”
ঠাকুরবাড়ির দুই সদস্য শান্তনু ও সুব্রত সম্পর্কে দুই ভাই। শান্তনু বিজেপির সাংসদ এবং কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী, অন্যদিকে সুব্রত গাইঘাটার বিধায়ক। দুই ভাইয়ের এই দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন তাঁদের মা ছবিরাণী ঠাকুর। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—“ক্ষমতার দম্ভে শান্তনু তার দাদা সুব্রতকে পারিবারিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। আমাকেও মা হিসেবে অপমান করেছে। সুব্রতর ন্যায্য অধিকার ফেরানোর দাবি নিয়ে এবং পরামর্শ নিতে আমি বড় জা মমতা বালা ঠাকুরের কাছে গিয়েছিলাম।”
আর এটাকেই রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে গেছেন শান্তনু। শান্তনুর দাবি অনুযায়ী, শুধু তাঁর মা নন, বিজেপির বিধায়ক হয়েও তাঁর দাদা সুব্রত ঠাকুর তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে এবং তাঁর জেঠিমা তথা তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতা ঠাকুরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পারিবারিক বিরোধ চরমে উঠতেই রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন উঠেছে, সুব্রত ঠাকুর কি তবে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন? শান্তনু ঠাকুর দাবি করেছেন—“দাদা সুব্রত ইতিমধ্যেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, এখন শুধু পতাকা হাতে তুলে নেওয়ার অপেক্ষা।”
তবে সুব্রত পাল্টা জবাব দিয়েছেন, “ওটা শান্তনুর মনগড়া কথা। গতবছর লোকসভার টিকিট না পেলে শান্তনুই তৃণমূলে যেত। আমার যোগ দেওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ঠাকুরবাড়ি ও মতুয়াদের স্বার্থেই আমি জেঠিমা মমতা বালা ঠাকুরের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমার কাছে আগে পরিবার, পরে রাজনীতি।” এছাড়া শান্তনুর বিরুদ্ধে আরও বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন সুব্রত। তাঁর দাবি, “শান্তনু নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে ঠাকুরবাড়ির ভিতরে দালালরাজ চালাচ্ছে। মতুয়া সমাজকে বিভ্রান্ত করছে।”
শান্তনুর পক্ষ থেকে পাল্টা অভিযোগ তোলা হয়েছে, নাটমন্দিরে ক্যাম্প চলাকালীন সুব্রত সেখানে গিয়ে ভক্তদের হুমকি দিয়েছিলেন। বর্ষার দিনে ভক্তরা যাতে সুষ্ঠভাবে মতুয়া কার্ড পান, তারজন্যই নাটমন্দিরে ক্যাম্প খোলা হয়েছে। যদিও সুব্রত দাবি করেছেন, “নাটমন্দিরে ভক্তদের নিয়ে সারা বছর বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। সেখানে ক্যাম্প করলে ভক্তদেরই অসুবিধা হবে বলেই আমি ওদের সরে যেতে বলেছিলাম।”
এই দ্বন্দ্বের মাঝেই বৈঠক করেছেন সুব্রত, তাঁর মা ছবিরাণী এবং তৃণমূল সাংসদ মমতা বালা ঠাকুর। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, এই বৈঠক নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে মমতা বালা ঠাকুর সরাসরি জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন—“সুব্রত-শান্তনু দু’জনই আমার সন্তানসম। পরিবারের মধ্যে গণ্ডগোল মেটাতেই সুব্রত এবং তাঁর মা আমার কাছে এসেছিল। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। তৃণমূলে যোগ দেওয়া-না দেওয়ার বিষয়ে সুব্রতের সঙ্গে কোনও আলোচনা হয়নি।”
ঠাকুরবাড়ি সবসময়ই বাংলার রাজনীতিতে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের জন্য অন্যতম শক্ত ঘাঁটি। সিএএ বাস্তবায়নকে ঘিরে মতুয়াদের মধ্যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষোভ—এই দুইয়েরই প্রকাশ ঘটছে। এবার সেই ইস্যুকেই কেন্দ্র করে ঠাকুরবাড়ির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিজেপির জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বন্দ্ব সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে মতুয়া সমাজের ভোটব্যাঙ্কের ওপর। আর সেই প্রভাব ২০২৬ বিধানসভা ও ২০২৯ লোকসভা নির্বাচনে বড় সমীকরণ তৈরি করতে পারে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন