Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

বুধবার, ৭ মে, ২০২৫

কেন এবং কিভাবে 'অপারেশন সিঁদুর’ জানালো ভারত সরকার

 

Operation-Sindoor

সমকালীন প্রতিবেদন : ‌দীর্ঘ তিন দশক ধরে পাকিস্তান মদতপুষ্ট জঙ্গীগোষ্ঠীগুলি ভারতের উপর একের পর এক হত্যালিলা চালিয়েছে। তারই শেষ ঘটনা পহেলগাঁও হত্যা। এই অবস্থায় জঙ্গীদের ঘাটিতে হাওলা করা ছাড়া ভারতের আর কোনও উপায় ছিল না। মঙ্গলবার শেষরাতে ভারত যে 'অপারেশন সিঁদুর’ এর ঘটনা ঘটিয়েছে, তা‌র ব্যাখ্যা দিল ভারত সরকার।  

বুধবার ভোররাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌসেনা ও বায়ুসেনার যৌথ পরিকল্পনায় পাকিস্তান ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে 'অপারেশন সিঁদুর’ স্ট্রাইক চালিয়েছে। এই ত্রিস্তরীয় সামরিক অভিযানে একযোগে আঘাত হানা হয় ৯টি কুখ্যাত জঙ্গিঘাঁটিতে। প্রতিটি জায়গারই অতীতে একাধিক বড়সড় সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছিল।

এদিন সাংবাদিক বৈঠকে বিদেশসচিব বিক্রম মিশ্রি বলেন, 'পহেলগাঁওয়ে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগ পাওয়া গেছে। ওই হামলা বর্বরোচিত ছিল। কাশ্মীরের উন্নয়ন থমকে দেওয়াই লক্ষ্য ছিল। হামলায় পাক জঙ্গি সংগঠন টিআরএফ এর যোগ প্রমাণিত। ভারত আত্মরক্ষার্থেই এই কাজ করেছে। বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স সূত্র মারফত খবর মিলেছিল, পাক ভূখণ্ডে জঙ্গিরা ভারতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আত্মরক্ষার্থেই ভারত হামলা চালিয়েছে। বেছে বেছে জঙ্গি ঘাঁটিতে হামলা। আশ্রয়দাতা হিসেবে গোটা বিশ্বে পরিচিত হয়েছে পাকিস্তান। আজ ভোররাতে পাক জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংসের জন্য নিয়ন্ত্রিত হামলা হয়েছে। ২৩ এপ্রিল প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত হয়। ১৩ দিন ধরে সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।' 

এপ্রিল মাসের ২২ তারিখ জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওএ পর্যটকদের উপর চালানো বর্বর হামলার প্রত্যুত্তর বলেই ধরা হচ্ছে এই অভিযানটিকে। সেদিনের হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ২৬ জন নাগরিক, যাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন পর্যটক। এই হামলার পিছনে ছিল পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তইবার শাখা সংগঠনের হাত। প্রথম থেকেই ভারত এই হামলাকে পাকিস্তান-পোষিত সন্ত্রাস হিসেবেই দেখেছে। এবং তারই জবাব হিসেবে লস্কর সংগঠন ও তার সহযোগী গোষ্ঠীগুলোর লজিস্টিক, প্রশিক্ষণ ও কমান্ড অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল অপারেশন সিঁদুরের প্রধান উদ্দেশ্য।

ভারতীয় সেনার পক্ষ থেকে 'অপারেশন সিঁদুর’ এর মাধ্যমে জঙ্গীদের যে যে ঘাটিতে হামলা চালানো হয়েছে, তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ভারতের লক্ষ্যস্থল ছিল সুনির্দিষ্ট ৯টি জায়গা। তার প্রতিটিই আগে একাধিক সন্ত্রাসী পরিকল্পনা ও অনুপ্রবেশ চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই ঘাঁটিগুলিকে কৌশলগত মূল্যায়নের মাধ্যমে বাছাই করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

অপারেশনের সময় ও কৌশল

বুধবার রাত ১টা ০৫ মিনিটে শুরু হয় এই যৌথ সামরিক অভিযান। চলে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। দূরপাল্লার স্ট্যান্ড-অফ অস্ত্র ব্যবহারে একযোগে হামলা চালানো হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর মধ্যে এই প্রথম এমন একত্র অভিযানের ঘটনা ঘটল ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর। ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, কোনও পাক সেনাঘাঁটি টার্গেট করা হয়নি। কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদী পরিকাঠামো ও জঙ্গি ঘাঁটিগুলিকেই নিশানা করা হয়েছে।

রাজৌরি ও পুঞ্চে হামলার লঞ্চপ্যাড গুলপুর —

২০২৩ ও ২০২৪ সালে গুলপুর অঞ্চলকে একাধিকবার সীমান্ত পেরিয়ে রাজৌরি ও পুঞ্চে সন্ত্রাসী হামলার প্রস্তুতিস্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখান থেকেই জঙ্গিরা ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে হামলা চালায়।

কাশ্মীর উপত্যকার হামলার সঙ্গে যুক্ত সাওয়াই —

উত্তর কাশ্মীরের সোনমার্গ, গুলমার্গ ও পাহালগামের একাধিক হামলার যোগসূত্র পাওয়া গেছে সাওয়াই ক্যাম্পের সঙ্গে।

জইশ-ই-মহম্মদের সদরঘাঁটি বাহাওয়ালপুর —

পাকিস্তানের দক্ষিণ পাঞ্জাবে অবস্থিত বাহাওয়ালপুর জইশ-ই-মহম্মদের সদর দফতর। মাসুদ আজহারের নেতৃত্বাধীন এই জঙ্গিগোষ্ঠী ২০০১ সালের সংসদ হামলা, ২০১৯ সালের পুলওয়ামা আত্মঘাতী হামলার মতো বহু ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। বাহাওয়ালপুরে জইশের ঘাঁটি ছিল বহুদিন ধরেই।

হিজবুল মুজাহিদিনের ঘাঁটি মেহমুনা এবং শিয়ালকোট —

শিয়ালকোটের কাছাকাছি অবস্থিত মেহমুনা ক্যাম্প হিজবুল মুজাহিদিনের পুরনো ঘাঁটি। সংগঠনটির প্রভাব কমে এলেও ভারতীয় গোয়েন্দারা মনে করছেন, এখান থেকে এখনও অনুপ্রবেশ ও প্রশিক্ষণের কাজ চলছে স্থানীয় সমর্থনের উপর ভর করে।

লস্কর-ই-তৈবার ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র মুরিদকে —

লাহোর থেকে প্রায় ৪০ কিমি উত্তরে অবস্থিত মুরিদকে হল লস্কর-ই-তইবা ও তার সমাজসেবামূলক মোড়কের সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়ার মূল কেন্দ্র। ২০০ একরেরও বেশি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই ঘাঁটিতে রয়েছে প্রশিক্ষণ এলাকা, মগজধোলাই ও ধর্মীয় কট্টরবাদ প্রচারের কেন্দ্র এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সংরক্ষণ ব্যবস্থা। ২০০৮ সালের মুম্বই হামলার জঙ্গিরাও এখানেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল।

আত্মঘাতী জঙ্গি ও অনুপ্রবেশ প্রশিক্ষণকেন্দ্র কোটলি —

পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের কোটলি বহুবার ভারতের গোয়েন্দা রিপোর্টে এসেছে। এখানে প্রতি সময়ে ৫০ জনের বেশি জঙ্গিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকাঠামো রয়েছে। আত্মঘাতী জঙ্গি তৈরিতে এই ঘাঁটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি।

অনুপ্রবেশ পথ সারজাল —

সারজাল আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণরেখার কাছাকাছি হওয়ায় বহুদিন ধরেই অনুপ্রবেশের মূল পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। ভারতের তরফে বহুবার এই অঞ্চলগুলোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।

অনুপ্রবেশের আর এক পথ বারনালা —

বারনালাও আন্তর্জাতিক সীমান্ত ও নিয়ন্ত্রণরেখার খুবই কাছাকাছি। ফলে এখান দিয়েও অনুপ্রবেশ হয়েছে অনেক দিন ধরে। আগা থেকেই ভারতের নজরে ছিল বারনালা।

লস্কর ও জইশের ক্যাম্প মুজাফফরাবাদ —

মুজাফফরাবাদের শাওয়াই নাল্লা ক্যাম্পে ছিল লস্কর-ই-তইবার তৎপরতা এবং সৈয়দনা বিলাল ক্যাম্পে জইশ-ই-মহম্মদের ঘাঁটি।

অপারেশনের পরপরই ভারত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করে। ভারতের শীর্ষ কর্তারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির প্রতিনিধিদের ব্রিফ করেন। অভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, এবং এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন