আজ গান্ধিজয়ন্তী : আমাদের অবস্থান একই সঙ্গে ধর্মে ও জিরাফে
স্বপন ঘোষ
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি নাথুরাম গডসের বুলেট যেদিন গান্ধিজির বুকটা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, সেদিন সেই মুহুর্তে তাঁর মুখ দিয়ে কেবল একটিই শব্দবন্ধ উচ্চারিত হয়েছিল : 'হে রাম!' আজীবন ধর্মপ্রাণ মানুষটির মুখ থেকে জীবনের শেষ সময়েও হিন্দুধর্মের অন্যতম অবতার শ্রীরামের নামই উচ্চারিত হয়েছিল।
অথচ হত্যাকারী গডসে পরে তাঁর জবানবন্দিতে লিখেছেন, সনাতন হিন্দুধর্মের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে গান্ধি যে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন, তার জন্যই তাঁকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল এবং এর জন্য তাঁর কোনও অনুতাপ নেই।
এখন আর কোনও শিক্ষিত ভারতীয়েরই জানতে বোধহয় বাকি নেই, গান্ধি হত্যার জন্য গডসেকে পাঠিয়েছিলেন স্বনামধন্য 'কাপুরুষ' ভারতীয় বিপ্লবী এবং জনসংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও তাত্ত্বিক নেতা দামোদর বিনায়ক সাভারকর।
কে এই সাভারকর ? মহারাষ্ট্রের তরুণ সাভারকর বাসুদেব বলবন্ত ফাঁড়কের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবনের প্রথম পর্বে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হন। পুনায় প্লেগ কমিশনার মি.রান্ড ও মি. আয়ার্স্টকে হত্যা করেছিলেন যে চাপেকর ভ্রাতৃদ্বয়, তাঁদেরই সহযোগী ছিলেন সাভারকর।
ধরা পড়ে চাপেকর ভাইদের ফাঁসি হলেও নাসিক ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সাভারকর বিদেশে পালিয়ে যান। পরে প্যারিস থেকে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে এবং বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় আন্দামানের সেলুলার জেলে। এ পর্যন্ত অগ্নিযুগের বাঙালি বিপ্লবী বারীন ঘোষ বা উল্লাসকর দত্তের সঙ্গে তাঁর জীবনের বেশ খানিকটা মিল পাওয়া যায়।
কিন্তু পার্থক্যের সূত্রপাত এরপর থেকে। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করে অসংখ্য ভারতীয় বিপ্লবী আজীবন সেলুলার জেলেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সাভারকর অন্যরকম ভেবেছিলেন। সেলুলার জেলে থাকতে থাকতেই তিনি নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ছকে ফেলেন।
উগ্র হিন্দুত্বকে তিনি তার জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে একের পর এক মার্জনাপত্র পাঠাতে থাকেন। রাজসাক্ষী হন তিনি। অবশেষে মুক্তি পান। মুক্তির পরেই হয়ে ওঠেন অন্য মানুষ। কংগ্রেস ও গান্ধিজির সত্য ও অহিংসা-নির্ভর উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উগ্র সমালোচক হয়ে ওঠেন।
গান্ধিজি ভারতের বহুমত-বহুধর্মের বাস্তবতাকে তাঁর ও কংগ্রেসের রাজনীতির প্রতিপাদ্য করেছিলেন। সাভারকরের অবস্থান ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত : হিন্দি, হিন্দু ও হিন্দুত্বকেই তাঁর স্বপ্নের ভারতের একমাত্র আদর্শ হিসাবে তিনি বিশ্বাস করতেন এবং রীতিমত প্রচার করতেন।
১৯৩০ থেকে ১৯৪৮ প্রায় তিরিশ বছর ধরে গান্ধিজির আদর্শের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে দেশে ও বিদেশে সাভারকর উগ্র হিন্দুত্ব প্রচারের চেষ্টা করেন এবং গান্ধিজি বেঁচে থাকতে তিনি এই প্রচেষ্টা সফল করতে পারেননি। সুতরাং, তাঁকে সফল হতে গেলে গান্ধিজিকে মরতেই হতো। তাই তাঁর মানসপুত্র গডসের আগমন।
১৯৪৭ এ দেশের স্বাধীনতার প্রাক মুহুর্তে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রধান নেতারা যখন ক্ষমতার দরাদরিতে মত্ত, গান্ধিজির অবস্থান তখন ক্ষমতা থেকে বহু দূরে : বেলেঘাটা কিংবা নোয়াখালিতে জীবন বিপন্ন করে সাম্প্রদায়িক হিংসা প্রতিরোধে তৎপর। আর জনসংঘ তো সরাসরি দেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল।
ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত দেশের স্বাধীনতা আমরা পেলাম। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতাকেই তার আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করল। কোথায় তখন জনসংঘ ? সাভারকর শূণ্যে ঘুঁসি ছুঁড়ছেন ! তাহলে কি হিন্দি, হিন্দু আর হিন্দুত্বের আদর্শ এদেশে কোনও দিনই আসবেনা ? সংবিধান চালু করার আগেই চূড়ান্ত একটা কিছু করতে হবে ! সুতরাং গান্ধি হত্যা!
দেশের স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষপূর্তির উৎসব করছে এমন একটি দল ও সরকার, স্বাধীনতার জন্য যারা একবিন্দু রক্তও ঝরায়নি ! এদেশের মানুষের ইতিহাস চেতনা আমাদের বিভ্রান্ত করবেই। গান্ধিজির নামে 'স্বচ্ছ ভারত' অভিযান চলছে!
আবার গডসেবন্দনাও চলছে সমান তালে। সাভারকরের নামে পোর্টব্লেয়ার বিমানবন্দরের নামকরণ করে সেলুলার জেলে বন্দী শত শত শহীদের আত্মবলিদানকে অসম্মান করা হচ্ছে। তারা ধর্মেও আছেন, আবার জিরাফেও আছেন ! আমরা কোথায় থাকব, কি হবে আমাদের অবস্থান, তারই উত্তর হবে আগামী দিনের ভারতবর্ষ। গান্ধিজি কিন্তু নীরবে বিমর্ষ হাসছেন !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন