Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২

গ্রাম-শহরের বাবুদের দুর্গোৎসব— পর্ব– ২

Durgotsava-of-Village-Babu-Culture–Part–2

গ্রাম-শহরের বাবুদের দুর্গোৎসব— পর্ব– ২ 

পীযূষ হালদার 


সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন পত্রিকার ফাগুন ১২৭৯ সংখ্যায় লিখেছেন– '‌যাহারা বাক্যে মনোমধ্যে এক, কথনে দশ, লিখনে শত এবং কলহে সহস্র, তিনিই বাবু। যিনি নিজ গৃহে শুধু জল খান, বন্ধু গৃহে মদ খান, বেশ্যা গৃহে গালি খান এবং মনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু। যাহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী বা উপগৃহিণীতে এবং রাগ কেবল সদগ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনি বাবু।'‌ 

উনিশ শতকের বাবু কালচার বাস্তবিকই এক সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরে। পুরনো কলকাতার বাবুদের অনেকেই পয়সা রোজগার করতেন অসৎ পথে লোক ঠকিয়ে। পাপস্খলনের উদ্দেশ্যে তারা করতেন দান–ধ্যান–পূজা–পার্বণ ইত্যাদি। 

চড়ক, রথযাত্রার পাশাপাশি দুর্গোৎসব ছিল উনিশ শতকের বাবু কালচারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ভুঁইফোড় বাবুদের চরম বিলাসিতা, চূড়ান্ত আমোদ-প্রমোদ, বিনোদন, বেলেল্লাপনা আর পারস্পরিক প্রতিযোগিতার নিদর্শন পাওয়া যেত দুর্গাপুজোয়। 

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সমাচারচন্দ্রিকার ১৩ অক্টোবর ১৮৩২ প্রকাশিত সংখ্যায় বিভিন্ন বাবুদের পুজো  উদ্যোগ ও উদযাপন প্রসঙ্গে লিখেছেন– '‌এবার দুর্গা পুজো উপলক্ষে নগর মধ্যে নৃত্যগীতাদির বাহুল্য তিন চারি স্থানে হইয়াছিল অর্থাৎ শোভাবাজারের মহারাজ বাহাদুরের উভয় বাটিতে ধারাবাহিক বোধন হইতে নবমী, মহানবমী পর্যন্ত নাচ, তামাশা হইয়াছে তদ দর্শনে এতদদেশীয় ও নানা দিগদেশীয় এবং উচ্চপদাভিষিক্ত সাহেবলোক গমন করিয়াছিলেন তদভিন্ন শ্রীযুক্ত বাবু আশুতোষ বাটিতে প্রতিপদাবধি নবমী পর্যন্ত নাচ হয়। তথায় নেক্কি প্রভৃতি নর্তকী নিযুক্ত ছিল ইহাতেই সকলে বিবেচনা করিতে পারিবেন তদবিষয়ে কি প্রকার আমোদ হইয়াছে।' 

শারদ উৎসব উপলক্ষে কলকাতার বিশেষ বিশেষ জমিদারবাবুর বাড়িতে শাসক গোষ্ঠীর প্রধানদের আগমন হতো। ১৮২৯ সালের ১০ অক্টোবরের বঙ্গদূত পত্রিকায় এইরকমই একটা অনুষ্ঠানের বর্ণনা আছে। সেই দুর্গাপূজার নবমীর রাত্রে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক এবং প্রধান সেনাপতি শোভাবাজার রাজবাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করেন। 

এছাড়াও, সেই সময় ইংরেজ অতিথিদের বিশেষ সমাগম হয়েছিল দেওয়ান শান্তারাম সিংয়ের বাড়িতে। জমিদারবাবুদের বাড়িতে দুর্গাপুজো উপলক্ষে শ্বেতাঙ্গরাই প্রধান অতিথি বলে গণ্য হতেন। সাধারণ বণিক সাহেবদেরও সেখানে সমাদর ছিল। তাদের তুষ্টিবিধান পুজোর অন্যসব আয়োজনকে ছাপিয়ে যেত। 

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটলে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ উল্লসিত হয়ে ওঠেন। ওই সালে কৃষ্ণচন্দ্র ও নবকৃষ্ণ দুজনেই লক্ষাধিক টাকা খরচ করে দুর্গাপুজো করেছিলেন। সে বছর ক্লাইভ কলকাতার নবকৃষ্ণের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি দুর্গাপুজোয় একশো এক টাকা দক্ষিণা আর ঝুড়ি ঝুড়ি ফলমূল পাঠিয়েছিলেন। 

নাচ, গান, স্ফুর্তি পুরনো কলকাতার দুর্গা উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। কলকাতার দুর্গোৎসবে প্রথম যিনি বাঈ নাচিয়ে ছিলেন তিনি হচ্ছেন মহারাজ নবকৃষ্ণ। তিনি ছাড়াও অনেক ছোট বড় জমিদারদের বাঈ নাচানোর রীতি ছিল। সেইসঙ্গে ফোয়ারা ছুটত মদের। 

এইসব লক্ষ করে গুপ্তিপাড়ার একদল ব্রাহ্মণ শাস্ত্রীয় পুজোর সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সার্বজনীন পুজোর প্রচলন করেন। ১৭৯০ সালের এই পুজোকেই বারোয়ারি পুজোর উৎপত্তিকাল বলে ধরা হয়। সেকালের বারোয়ারি পুজোর আমোদ-প্রমোদ অন্য ধরনের ছিল। এই পুজোয় সঙ সাজা ছিল সব থেকে বড় আকর্ষণ। 

এসব কারণেই পুরনো কলকাতার বাবু কালচারের সাক্ষী হয়ে আছে দুর্গোৎসব। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাচ-গান-স্ফুর্তির উন্মত্ত বিলাসিতা। 

*‌ঋণী— অভিষিক্তা পত্রিকায় সুমিত তালুকদারের লেখা একটি নিবন্ধ ও বিভিন্ন সংবাদপত্র। 






      

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন