আগমনী থেকে বিজয়া
পীযূষ হালদার
আগমনী আর বিজয়া। সূচনা ও সমাপ্তিতে এই দুর্গাপূজা। এই দুয়ের মধ্যবর্তী সময়ে যতটা শাস্ত্র অনুসারে আচার বিচার ভক্তি-শ্রদ্ধা ভালবাসার আয়োজন, ঠিক ততটাই স্বামীগৃহ থেকে কন্যার বাপের বাড়িতে আসা-যাওয়ার উৎসব। আগমনীতে বাবা মায়ের সঙ্গে মিলনের আনন্দ, বিজয়ায় সেই আনন্দের বিসর্জন।
আগমনীতে মেনকার অনুরোধে গিরিরাজ কৈলাসে যান মেয়েকে আনতে। তাই আগমনী সুরে বাজে মায়ের সেই ব্যাকুলতা, উৎকণ্ঠা। তাইতো কবি দীনেশ দাস লিখেছেন–
"আকাশ গেয়েছে আগমনী গান
কত সুর যে সেধেছে,
যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী,
উমা যে আমার কেঁদেছে।"
রামপ্রসাদ গেয়েছেন–
"ওগো রানি, নগরে কোলাহল, ওঠ চল চল,
নন্দনী তোমার নিকটে গো।
চল বরণ করিয়া, গৃহে আনি গিয়া,
এসো না সঙ্গে আমার গো।।"
তারপর একেবারে ঘরোয়া সেই আয়োজনে বাঙালি গৃহস্থের স্বকীয় আন্তরিকতার ঘনঘটা এই পূজোয়। শাস্ত্র মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি কোনও পুরুষ নয়, নারী। পরমব্রহ্ম দেবী এক এবং অদ্বিতীয়। অন্যসব দেবী এই মহাশক্তি দেবীর অধীন। দুর্গা, কালী, চন্ডী সেই দেবীর বিভিন্ন রূপ।
বাংলায় বৈদিক ধর্মের আগমনের আগে থেকে মঙ্গল চন্ডী, ওলাই চন্ডী ইত্যাদি চন্ডী পূজার চল ছিল। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে চণ্ডীমঙ্গলগুলি রচিত হতে থাকে। চণ্ডীর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ফলে হিন্দু ধর্মের মূল ধারায় স্থান দেওয়া হয়। একসময় চন্ডীই হয়ে গেলেন দেবী দুর্গার সমার্থক।
দেবী দুর্গার মর্তে আগমনের কারণ নির্দেশ করেছে এক এক পুরাণে এক এক রকম। পুরাণের বিধান যাই থাক, দেবী দুর্গা বাংলায় আসেন বাঙালির ঘরের কন্যা হিসেবে। মহালয়ার পরে শুরু হয় দেবীপক্ষের। সেই সময়ের থেকেই উৎসবের আয়োজন শুরু হয়।
কোনও কোনও মন্ডপে বা চণ্ডীমণ্ডপের দেবী দালানের বেদিতে প্রতিমা প্রতিস্থাপনের পর মহালয়ার পরদিন থেকেই শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। পঞ্চমীতে হয় বোধন, ষষ্ঠীতে ষষ্ঠী পূজা, সপ্তমী পূজার পর অষ্টমীতে আখ ও কুমড়ো বলি দেওয়া হয় কোনও কোনও জায়গায়। এইভাবে পূজার প্রতিটি স্তর পেরিয়ে বিজয়াদশমী আসে । তারপরে প্রতিমা নিরঞ্জন। তারপর সামনের বার তঁর আসার পথ চেয়ে থাকা।
এবারে আসা যাক বিজয়ার কথায়। জগৎ ঈশ্বরী যখন ঘরের মেয়ে হয়ে পিত্রালয় থেকে রওনা দেন স্বামীর ঘরের উদ্দেশ্যে, তখন নেমে আসে এক শূন্যতা। এই শূন্যতাবোধকে জয় করতে বাঙালিরা বলে বিজয়। বিজয়া তাই এক সময়ে হয়ে উঠল ভালোবাসা, আশীর্বাদ, শুভকামনা বিনিময়ের এক মিলনমেলা।
রামপ্রসাদ গেয়েছেন–
"বলে মা, এলে মা এলে, মা বলা কি ভুলে গেলে।
মা বলে,একি কুথা মার গো ।।
রথ হতে নামিয়া শংকরী মায়েরে প্রণাম করি।
সান্ত্বনা করে বারবার।। "
এই সান্তনাটুকুই বিজয়ার মর্মসুর।
বিজয়া আসলে বিজয় উৎসব পালন করা। মহিষাসুর নিধনের পরে স্বর্গের দেবতারা বিজয় উৎসব পালন করেছিলেন। রাজা নবকৃষ্ণ ভেবেছিলেন, সিরাজদৌলার পরাজয় মানে হিন্দুদের জয়।
তাই তার প্রতিমা বিসর্জনের পর্ব ছিল একেবারে অন্যরকম। ঢাকি-ঢুলি ব্যান্ডপার্টি আর আলোর রোশনাই নিয়ে বের হতো মস্ত শোভাযাত্রা। সে ধারা এখনও বজায় আছে। এখন বাংলার মানুষ কার্নিভালের আনন্দে মেতে ওঠে বিজয়ের দিন।
ইউনেস্কোর (UNESCO) হেরিটেজ তকমা পেয়েছে দুর্গাপুজো। ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশন্যাল, সায়েন্টিফিক এণ্ড কালচারাল অর্গানাইজেশনের তরফে গত বছর ডিসেম্বর মাসে তাদের রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অফ ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ তালিকায় স্থান দিয়েছে। এবার আরও আনন্দময় হয়ে উঠুক দুর্গাপুজো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন