একটা স্কুল কিভাবে তিলে তিলে তিলোত্তমা হলো
অজয় মজুমদার
স্কুলটির নাম মাইকেলনগর হাইস্কুল৷ দমদম এয়ারপোর্টের ঠিক বিপরীতে৷ বিদ্যালয়ের একটা সেমিনারে আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল৷ বিষয় ছিল– শিশু শিক্ষা, পুষ্টি ও অভিভাবকদের ভূমিকা। খুব অবাক হয়েছিলাম। ছাত্রসংখ্যা একশোর নিচে৷ তাহলে কেনইবা এই ব্যবস্থা৷ প্রধান শিক্ষক অমিয় বিশ্বাস তখন অল্প কিছুদিন যোগদান করেছেন এই স্কুলে। শিক্ষক সংখ্যা ১০ জন মতো হবে৷
ছাত্র সংখ্যা কম কেন ? এই প্রশ্নটা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কলকাতার মধ্যে বাংলা মিডিয়ামে পড়ে ছাত্র ও অভিভাবকরা কৌলিন্য হারাতে চাইছে না। যদিও এলাকাটিতে একেবারেই মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র পরিবারের বসবাস। কিছু সম্পন্ন পরিবার এখানে এসেছে ফ্ল্যাট কালচারের দৌলতে৷ পুরনো বাসিন্দা সবাই প্রায় মধ্যবিত্ত। স্কুলটা দেখে সকলেরই পছন্দ হবে। কারণ অনেকখানি জমির ওপর স্কুলটি। নিজস্ব খেলার মাঠ আছে। যা কলকাতার স্কুলগুলিতে বিরল। কিন্তু যাদের জন্য সবকিছু, সেই ছাত্রই তো নেই।
এবার লড়াই শুরু করলেন প্রধান শিক্ষক অমিয় বিশ্বাম। তিনি প্রথমে এলাকাটি সমীক্ষা করে দেখলেন। জানা গেল, সেখানকার মানুষ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর পক্ষে। তাই প্রধান শিক্ষক এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা অনুরাগী মানুষদের ডেকে বলেন তাঁর মনের ইচ্ছা। প্রত্যেকে রাজি হয়ে যান, ইংরাজী স্কুলে পরিনত করবার জন্য।
মধ্যমগ্রামের চেয়ারম্যান এবং মন্ত্রী রথীন ঘোষ এই বিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রধান শিক্ষকের ইচ্ছা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। এবার ছোটার পালা শুরু। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল করবার জন্য পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের কাছে আবেদন করল স্কুল কর্তৃপক্ষ৷
শেষ পর্যন্ত অনুমোদন মিললো। বিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে শিশু শিক্ষা, শিশু স্বাস্থ্য, খাদ্যাভ্যাস এবং সাইকিয়াট্রিক কাউন্সেলিং এর ওপর সেমিনার শুরু হল বিভিন্ন জ্ঞানী গুণী মানুষকে দিয়ে। অভিভাবকদের স্কুলে বারবার ডাকতে শুরু করলেন আন্তরিকভাবে৷
স্কুলটি ইংরেজি মাধ্যম হলো ঠিকই, কিন্তু পড়াবেন কারা? কিছু পার্ট টাইম শিক্ষক নিয়োগ করে এবং নিজে খেটে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল চালু করলেন প্রধান শিক্ষক। বর্তমানে স্কুলের দুটি ব্যাচ কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক পাশ করেছে৷ ল্যাবোরেটরি উদ্বোধন হয়েছে খুব ধুমধাম করে। মিড ডে মিল চলছে প্রধান শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে৷ একটা ছোট্ট স্কুল কিভাবে ফুলে ফলে সম্বৃদ্ধ হল সেটাই দেখার বিষয়।
বর্তমানে এই স্কুলটি এলাকার নামকরা স্কুলে পরিণত হয়েছে৷ এটা কৃতিত্বের বিষয় তো বটেই। কলকাতার বহু বাংলা মাধ্যম স্কুল এইরকম ছাত্রের অভাবে রুগ্ন হয়ে আছে। একটু চেষ্টা করলেই মাইকেলনগর স্কুলের মতো ভরা যৌবন আনা সম্ভব। তবে অনেক আন্তরিক ও নিষ্ঠা দিয়ে এগোতে হবে। বিশেষ কিছু পরিষেবা দিতে হবে।
ভাষাশিক্ষাই যখন এতটা চাহিদা, তখন স্পোকেন ইংলিশ ও স্পোকেন হিন্দি ক্লাসের জন্য তৎপর হতে হবে। স্পেশাল ক্লাস করতে হবে। ইউনিট টেস্ট নিতে হবে। মাঝে মাঝে আকর্ষনীয় কিছু প্রোগ্রাম করাতে হবে। শিক্ষকদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক টিম তৈরী করতে হবে। পাঠ্যসূচির বাইরে যার যে যে ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের দিকে আগ্রহ বেশি, তাকে সেদিকে এগিয়ে দিতে হবে।
মোট কথা, স্কুল যেন শিক্ষার্থীর কাছে আকর্ষনীর হয়ে ওঠে। এইরকমভাবে দু-এক বছর চালাতে পারলে এলাকায় পরিচিতি বাড়বে৷ স্কুলকে আর ছাত্রের অভাবে ভুগতে হবে না৷ তবে তার জন্য একটা আন্তরিক বাসনা প্রয়োজন।
স্কুল শিক্ষকতা বিষয়টাকে শুধুমাত্র চাকরি হিসেবে দেখলে হবে না। সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে হবে। তবেই পুনরায় বিদ্যালয়ে সফলতা আসবে। শিক্ষা দপ্তরকেত্ত খবরদারী কমাতে হবে৷ কারণে–অকারণে ছুটি দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন