Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২

একসময়ের পরিযায়ী শ্রমিক, এখন কৃষকরত্ন, গ্রামের 'অন্নদাতা'

 ‌

Once-a-migrant-worker-now-a-success-farmer

সমকালীন প্রতিবেদন : পেটের টানে একসময় ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে তিনিই এখন সফল কৃষক। চাষাবাদ করে শুধু যে নিজের লক্ষ্মীলাভ হয়েছে তা নয়, এলাকার কৃষকদের মুখেও হাসি ফুটিয়েছেন তিনি। কার্যত গোটা গ্রামের 'অন্নদাতা'। উন্নত কৃষির পাঠ দিতে প্রথমে গড়েছিলেন ফার্মার্স ক্লাব। পরে গড়ে তুলেছেন ফার্মার্স প্রোডিউসার কোম্পানি। এর সদস্য সংখ্যা সাড়ে চারশো। নতুন নতুন চাষে যাঁরা নয়া দিশা দেখাচ্ছেন এলাকায়। পাশে দাঁড়িয়েছে রাজ্য কৃষিদপ্তরও।

এই অনবদ্য সাফল্যের জন্য কৃষকরত্ন পুরষ্কারও পেয়েছেন জলপাইগুড়ির কৃষক ভগীরথ রায়। আক্ষরিক অর্থেই চাষ করে এখন লাখপতি তিনি। কিন্তু এই সাফল্যের পথটা মোটেই মসৃণ নয়। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু লড়াই ছাড়েননি। বরং আরও বেশি করে জেদ চেপে বসেছে মনের কোণে। চাষের ফাঁকে নিজেই জানালেন তাঁর সেই উত্তরণের কাহিনী।

জলপাইগুড়ির কোতয়ালির প্রভুপাড়ার বাসিন্দা ভগীরথ। বাবা সুশীলকুমার রায় চাষাবাদ করেন। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চলত না। তবুও কষ্ট করে পড়াশোনা শিখিয়েছেন ভগীরথকে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর ২০১১ সালে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হন হলদিবাড়ি কলেজে। কিন্তু বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে সাহায্য করতে গিয়ে ঘাটতি হয় পড়াশোনায়। নম্বর কমে যায় প্রথম বর্ষের পরীক্ষায়। বুঝতে পারেন অনার্স থাকবে না। এরপর বাংলা পড়া ছেড়ে ভগীরথ ভর্তি হন আইটিআইয়ে। ২০১৪ সালে পাশ করেন আইটিআই। কিন্তু চাকরি কোথায়!

এদিকে, নতুন নতুন ফসল ফলানোর চেষ্টা করলেও লাভ তো দূরের কথা, শুধুই লোকসান। এভাবে আর কতদিন। শেষমেশ একরাশ মন খারাপ নিয়ে সংসারের হাল ধরতে কাজের খোঁজে কেরলে পাড়ি দেন ভগীরথ। তাঁরা তিন ভাই, চার বোন। এক দাদা পার্থ রায় আগে থেকেই কেরলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করছেন। অন্য দাদা অচিন্ত্যকুমার তখন টিভি, ফ্রিজ, এসি মেশিন সারানোর কাজ করেন। বিয়ে হয়ে গিয়েছে বোনেদের।

আইটিআইর ডিগ্রি থাকার সুবাদে কেরলে গিয়ে একটি মেকানিক্যাল কাজ জোটে। কিন্তু তাতে মন বসছিল না ভগীরথের। মনের কোণে সুপ্ত ইচ্ছা, উন্নতপ্রথায় চাষ করে যে লাভবান হওয়া যায়, তা বাবাকে যদি দেখাতে পারতেন। এই ইচ্ছেকেই বাস্তবে রূপ দিতে কাজের ফাঁকে উন্নত চাষ নিয়ে কোথায়, কী ট্রেনিং হচ্ছে, তার খোঁজ রাখতেন। অংশ নিতেন। এভাবেই কেরল থেকে চলে আসেন চেন্নাই। সেখান থেকে রাজ্যে ফেরেন ২০১৭ সালে। 

কিন্তু বাড়ি না গিয়ে লজ ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন কলকাতায়। ততদিনে জেদটা আরও চেপে বসেছে মনের ভিতর। কৃষিতে যে লক্ষ্মীলাভ হয়, সেটা করে দেখাবেনই। আর যতদিন না সেটা করে দেখাতে পারছেন, ততদিন বাড়ি ফিরবেন না। চলতে থাকে লড়াই। নিজের সঙ্গে নিজেরই। মাছচাষে স্বনির্ভরতার ট্রেনিং নেন বেলুড় মঠে রামকৃষ্ণ মিশন সমাজসেবক শিক্ষণ মন্দির থেকে। উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙা সরকারি পোল্ট্রি খামারে গিয়ে জানার চেষ্টা করেন, কীভাবে হাঁস-মুরগি পালন করতে হয়।

দিনের পর দিন পড়ে থেকে ঝুলিতে সঞ্চয় করেন কিছু অভিজ্ঞতা। এর পর ভিন রাজ্যে কাজ করে যেটুকু টাকাপয়সা সঞ্চয় করেছিলেন, তা দিয়েই মাছচাষ আর পোল্ট্রি খামার করার সিদ্ধান্ত নেন। বাড়ি ফেরেন। বাড়ির পুকুরে কই, শিঙি, মাগুরের চারা ছাড়েন। গোবরডাঙা পোল্ট্রি খামার থেকে ডিম এনে বাচ্চা ফোটান। এরই মধ্যে বন্যা আসে। পুকুরের মাছ সব ভেসে যায়। লোকসান হয় প্রচুর টাকা। 

কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন এবার। ভেবে না পেয়ে আবার পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে পাড়ি দেন ভিন রাজ্যে। এবার কর্ণাটক। কিন্তু আবারও একই ঘটনা। কাজ করতে করতেই ঝোঁক হয় রঙিন মাছ চাষের কৌশল শেখার। কর্ণাটক থেকে চলে আসেন ওড়িশার ভূবনেশ্বরে। সেখানে সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ফ্রেশ ওয়াটার অ্যাকুয়াকালচারের (সিফা) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। 

এখান থেকেই রঙিন মাছ চাষের প্রশিক্ষণ নেন। এর পর চেন্নাই থেকে জাপানি কই কার্পের ইজরায়েল প্রজাতির কিছু বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফেরেন ২০১৯ সালে। ছেলের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে পাশে দাঁড়ান মা অণিমা রায়। ৯০০ টাকা পিস হিসেবে একশোটি জাপানি কই কার্পের চারা এনেছিলেন। সেগুলিকে বড় করে তা থেকেই বাচ্চা উৎপাদন শুরু করেন। এখন ভগীরথের পুকুর থেকে জাপানি কই কার্পের চারা বিক্রির জন্য যায় অসম, মণিপুর, ত্রিপুরার মার্কেটে। 

ভগীরথ ‌জানালেন, 'দু'মাসের বাচ্চা ১৫-২০ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি করি। ট্রেনে বুকিং করে পাঠিয়ে দিই।'‌ শুধু মাছ চাষ নয়, এখন কৃষি দপ্তরের সহযোগিতায় হাইটেক পদ্ধতিতে আলুর বীজ উৎপাদন করছেন ভগীরথ। বললেন, 'ভাইরাসমুক্ত বীজ উৎপাদনের জন্য মশারির নীচে কুফরি, হিমালিনী, খেতি, সুখখেতি, জ্যোতি, পোখরাজ, চন্দ্রমুখী প্রভৃতি জাতের আলুর চাষ করছি। সবমিলিয়ে তিন হাজার বর্গ মিটার এলাকায় এই চাষ চলছে।'‌ 

২০১৯ সালে ভগীরথের হাত ধরে গড়ে ওঠে মালকানি ফার্মার্স ক্লাব। ২০ জন কৃষককে নিয়ে শুরু হয়েছিল পথ চলা। ধীরে ধীরে নিজের কাজের পরিধি বাড়িয়েছেন। করোনাকালেই ২০২১ সালে গড়ে তোলেন মালকানি ফার্মার্স প্রোডিউসার কোম্পানি। স্থানীয় খারিজা বেড়ুবাড়ি ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তত কুড়িটি গ্রামের কৃষকেরা এই ফার্মার্স প্রোডিউসার কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা কড়কনাথ মুরগি পালন করছেন। মধ্যপ্রদেশ থেকে ৯০ টাকা পিস হিসেবে ওই মুরগির ১৫ দিনের বাচ্চা নিয়ে আসেন। বড় করার পর ৩০০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি হয়ে যায়। 

লাক্ষাদ্বীপ থেকে নিয়ে আসেন টার্কির বাচ্চা। একমাসের বাচ্চার দাম পড়ে যায় ২০০ টাকা পিস। টার্কির মাংস বিক্রি হয় ৪০০ টাকা কেজি দরে। দেশি প্রজাতির ছাগল ব্ল্যাক বেঙ্গলও চাষ করেন তাঁরা। ভগীরথের দেখাদেখি এলাকার আরও কয়েকজন কৃষক রঙিন মাছ চাষ শুরু করেছেন। তাঁদেরকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সিফার পক্ষ থেকে ভগীরথের গ্রামেই রঙিন মাছ চাষের পাঠ দিতে ফিল্ড স্কুল খোলা হয়েছে। 

বরাবর নতুন চাষে ঝোঁক ভগীরথের। বললেন, 'আমরা এবার ভেষজ চাষের এলাকা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। অশ্বগন্ধা চাষ করেছি। কিন্তু প্রথমবার ভালো হয়নি। কোথায় ঘাটতি ছিল, সেটা বুঝতে পেরেছি। পরেরবার সেগুলো লক্ষ্য রেখেই চাষ করব।'‌ তবে ক্যামোমাইল চাষ করে বেশ সাড়া ফেলেছেন। সফল এই কৃষকের কথায়, অনেকটা মৌরি গাছের মতো দেখতে হয় ক্যামোমাইল গাছ। 

এই গাছের ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি চা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর বলে দাবি করেছেন গবেষকরা। তাঁরা বলছেন, ক্যামোমাইল চায়ের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সি়ডেন্ট রয়েছে, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। হার্টের জন্যও দারুণ উপকারি। মাদারিহাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর হাত থেকে কৃষকরত্ন পুরষ্কারও নিয়েছেন ভগীরথ। ‌তিনি জানালেন, 'আজ আর শুধু নিজের সাফল্য নিয়ে ভাবি না। গ্রামের সমস্ত কৃষককে লাভজনক কৃষির পথ দেখানোই আমার একমাত্র লক্ষ্য।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন