ধোত্র থেকে টংলু হয়ে টুমলিং ট্রেকিং
দীপক মন্ডল
পরিবার জানতে চায়, কেন তাদেরকে ফেলে রেখে আমি আর দেবা শতকাজের মাঝেও অন্তত বছরে একবার ট্রেকে যাই। আমি বোঝাতে পারি না। ২০১৮ তে অর্ণব টিকিট কাটলেও যেতে পারে নি। ওরও ইচ্ছে এবার পূরন হবে। ট্রেক শব্দটি আজকাল খুবই জনপ্রিয়। ২০০৩ সালে মনোজ সান্দাকাফু (Sandakafu) ট্রেক শেষ করেছে। একেবারেই নতুন হলো কল্যান। সঙ্গে সবার গোটা পরিবার। আমার আবার দুটি কন্যা সন্তান। ছোটটি হিতি, বয়স ৫। যেন একটি গতিমান ফড়িং। আমার সমস্ত চিন্তা তাকে নিয়েই। যাওয়ার আগে ওজনটাও মেপে নিলাম। ১৭.৮ কেজি। পিঠে করে নেওয়া যাবে, কিন্তু খুব বেশিক্ষন সম্ভব হবে না। ভাবলাম, পোর্টার দিয়ে বহন করাবো। কিন্তু কন্যা যদি অচেনা মানুষকে দেখে ভয় পায়, অথবা বিরক্ত হয়, তবে আমার রাস্তায় বসে থাকতে হবে। সে আবার রেগে গেলে একজায়গায় দাড়িয়ে থাকে। ১৬ অক্টোবরের দুপুরে মানেভঞ্জনে হোটেল প্রধানে লাঞ্চ করলাম আমরা ১৬ জন। সকালে নিউ জলপাইগুড়ি (NJP) স্টেশন থেকে, এমনকি ট্রেন থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা (Kanchenjunga) দেখা যাচ্ছিল। আমরা তেমন গুরুত্বই দিলাম না। তাই বলে এইরকম চূড়ান্ত প্রতারণা! সারা ট্রেকে, তার সঙ্গে আর দেখাই হলো না। বৃষ্টি আর বৃষ্টি। অন্ধকারাচ্ছন্ন চারিদিক। পাহাড়ি পরিবেশ, একেবারেই মায়াবী। কিন্তু এইরকম খারাপ আবহাওয়া আমার অক্টোবরের ইতিহাসে নেই।
পাঁচটি পরিবার যখন একই সঙ্গে লোকাল ট্রেনে একই কম্পার্টমেন্টে উঠলাম, তখন বিশ্বাস হলো, হ্যাঁ আমরা শেষপর্যন্ত চলেছি। কিন্তু যখন বেলা চারটের ধোত্র (Dhotra) এসে পৌছোলাম, আকাশ তখন মেঘলা। দেবাশীষ চলে গেলো মনোজ ভাইয়ার বাড়ি। সে আছে কি না খোঁজ করতে। ওর সঙ্গে দেবাশীষের খুব ভাব। মনোজ তামাংকে খুঁজে পেয়ে একেবারে পাকড়াও করে এনেছে। ওকে এমন ভাবে ধরে আনছে যেন, কুম্ভ মেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই। আমার সঙ্গে রাস্তায় দেখা। কোলাকুলি হলো একপ্রস্থ। ২০১৮ সালের সান্দাকাফু ট্রেকে মনোজ আমাদের গাইড ছিলেন। ওর বিশ্বাসযোগ্যতা সন্দেহাতীত। আমারও পছন্দ। ওকে যদি একদিনের পোর্টার হিসাবে পেতাম, তবে আমাদের সবচেয়ে ছোট সদস্যকে নিয়ে আর চিন্তা থাকে না। দেবাশীষ শেষ পর্যন্ত আমার দুশ্চিন্তা দূর করে। পাঁচটি পোর্টার জোগাড় করে ফেললো। সকালেই দেখি, মনোজ ভাইয়া বাকি চারজনকে সঙ্গে করে হাজির। রাতের প্রবল বৃষ্টির আর চিহ্নমাত্র নেই। কিন্তু আকাশ মেঘলা। আমাদের দলের প্রমিলা বাহিনী আর ছোটরা তখনও বিশ্বাস করতে পারছে না, আমরা হেটেই টুমলিং (Tumling) পৌছাবো। ওরা ভেবেছে গাড়ি করে যাবে।
আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম। কয়েকটি ঘোড়ার সঙ্গেও দেখা যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে। এমবিয়েন্স তৈরী। দেবাশিষের দেওয়া, 'হর হর মহাদেব' ধ্বনিতে গলামিলিয়ে আমরা সবাই পাও মেলালাম। পাইন গাছের জংগলে, পাখির ডাক শুনতে শুনতে এগিয়ে চললাম আমরা। পথের মধ্যমণি হয়ে চললো তোজো, অস্মি, তীর্থ, দেবার্ঘ, কৌশি এবং সেদিনের সকলের নয়নের মণি ছোট্ট হিতি। কারণ সহজেই অনুমেয়। ট্রেকের আনন্দ ও একাই ডুবিয়ে দিতে পারে। দেবাশীষ দায়িত্ব পেলো হিতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এবারে মহাষৌধির কাজ করলো, Mango Bite লজেন্স। দেবাশীষ আর তোজো মিলে, ব্লুটুথ স্পিকারে গান বাজালো। আমরাও তালে তালে হাটতে লাগলাম। বন্ধু মনোজের তীক্ষ্ম দৃষ্টি টিমের প্রতিটি সদস্যদের উপর। বন্ধু অর্ণবের আবার মুনি-ঋষির মতো প্রাঞ্জতা, কম কথা বলাকে আমরা সমীহ করছি। কল্যান তার নীরবতা ভঙ্গ করে, আজ যে সে কত কথা বলে চলেছে।
আড়াই কিমি যাওয়ার পর, চললো ফটোশুট। আর তার পর বুগিয়ালের উপর চললো, Go as you like to dance। হঠাৎই হিমালয়ের দেবতা একটু প্রসন্ন হলেন। চারিদিকে মেঘ সরে গেলো। অপার্থিব আলোয় ভরে উঠলো বুগিয়ালের মতো ঘাসে ভরা মাঠটি। আমরা যে যার মতো মাঠে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। ছোট্ট চকোলেট ব্রেকও হলো। আমরা চললাম, শেষ ধাপের চড়াই অতিক্রম করে টংলুতে পৌঁছাতে। ১০০৭০ ফুট উঁচু। জানুয়ারি পরবর্তীতে বরফের চাদরে ঢেকে যায়। ইতিমধ্যে বৃষ্টি তাড়া করলো। রেইনকোর্ট অথবা পঞ্চ পরে নিলাম। যার কাছে ছাতা আছে, সেটা দিয়েই কাজ চালালো কেউ কেউ। দলের ছোট্ট সদস্যা একটু ভীজে গিয়ে তার মা-বাবার কাছে যাওয়ার বায়না ধরলো। তার প্রিয় মনোজ কাকু, দেবাশীষ কাকু ও আমার আসার অপেক্ষা করতে লাগলো। ওকে খুশি করার জন্য একটু পিঠে চড়ালাম। কিছু পোশাক পরিবর্তন করে দিলে, তাতে উপরের জোরে হাওয়া আটকে গেলো। এবার উনি আবার দেবাশীষ কাকুর কাছে ম্যাঙ্গ বাইটের বায়না পুনরায় চালু করলো।
শেষপর্যন্ত টংলুতে (Tonglu) রাজুর হোমস্টেতে আমরা কফি পান করে নিজেদের একটু তরতাজা করলাম। ইতিমধ্যে অস্মির আবার মাথা ধরেছে। শরীর টা ভালো লাগছিলো না। কফি খেয়ে সেও একটু ধাতস্ত হলো। বাচ্চাদের মায়েরা যেমন– ঝিমলি, অন্তরা, সোমা, কেতকী, কাকলি সবাই ফিট এবং ফাইন। আমাদের আজকের শেষ অংশের উৎরাই বাকি। টংলু থেকে টুমলিং- ২ কিমি। সরাসরি নামতে হবে। চড়াই এ যে পেশীগুলি টান লাগে, উৎরাই এ ঠিক তার উল্টো। সবাই খুব দ্রুত নামছে। কিন্তু অতিরিক্ত কষ্টের কারনে যার মনে যা আসছে, সে সেটাই মুখে বলছে। বৃষ্টি গুটিগুটি পায়ে সঙ্গে চলেছে। কৌশি, আমার বড়ো কন্যা কোনও দিন বেশি হাটতে পছন্দ করে না। পেশিতে টান খেলে ছুটে আসে আমার কাছে। ওর পা নাকি 'ধুকধুক' করে। সেও আজ মাত্র এগারো বছর বয়সে বড়োদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাটছে। আজতো ছোটোদের বড়ো হয়ে যাওয়ার দিন।
এমনই একসময় কয়েকজন লোক যারা টুমলিং থেকে টংলু আসছিলেন, হঠাৎই হিতিকে বলে উঠলো, 'Brave boy, are you not interested to make friends with me' বলেই হাত বাড়ালো। সেই ভদ্রলোক আরও যোগ করলেন, 'you know, what have you done! You are travelling through the Mighty Himalays, Legacy continues....' তারপরই অনেকগুলি গাড়ি চলে এলো উপর এবং নীচ থেকে। আমরা ওনাদের ধন্যবাদ পর্যন্ত ঠিক করে বলে উঠতে পারি নি। ঘন কুয়াশায় হিতি হেটে চলেছে উৎরাই এর পথে। কখনও কখনও সে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। আবার গাড়ির আওয়াজে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়েও পড়ছে। আমাকে আবার সাবধানও করছে। আজকের মতো গন্তব্য শেষ। কিন্তু চলার পথ পড়ে রইলো হিমালয়ের আনাচে -কানাচে। ওরা আরও বয়সে বড়ো হবে, আমাদের প্রজন্ম চলে যাবে, কিন্তু হিমালয় (The Himalayas) চিরন্তন। তার কোনও ধর্ম-বর্ণের বেড়াজাল নেই। তার বিশালত্বের সামনে মানুষের ক্ষুদ্রত্ব প্রকট হয় বারে বারে। নিজের ক্ষুদ্রতার আত্মোপলব্ধির জন্যই তার সামনে বারে বারে যাওয়া, নতজানু হয়ে বসে পড়া।
যাত্রাপথ- নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন (NJP Rail Station) থেকে গাড়িতে ধোত্রে. ভাড়া ৪ হাজার টাকা।
ট্রেকিং রুট- ধোত্র থেকে টংলু হয়ে টুমলিং- ৮ কি.মি. পথ।
থাকার জায়গা- শেরপা নিবাস এবং পদ্মা হোমস্টে(ধোত্র), শিখর লজ, সিদ্ধার্থ লজ (টুমলিং)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন