Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

সোমবার, ৪ অক্টোবর, ২০২১

উত্তর সম্পাদকীয় : ‌অনেক রোগ বংশগত–আবার শিক্ষাও পরম্পরা

 ‌

Many-diseases-are-hereditary

অনেক রোগ বংশগত–আবার শিক্ষাও পরম্পরা

অজয় মজুমদার

আমরা তখন বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। দীঘায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ক্ষেত্র সমীক্ষার জন্য ৷ আমরা অনার্সের মোট ১২ জন ছাত্র উপস্থিত ছিলাম ৷ সঙ্গে ছিলেন দুজন শিক্ষক ৷ তখন বঙ্গবাসী কলেজ জীববিজ্ঞানে খুব সুনাম। খুব নামিদামি শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা ছিলেন ভীষণ আন্তরিক। আমাদের বন্ধু আনন্দকে আমরা গ্রুপ লিডার করেছিলাম ৷ আনন্দ যখন শিক্ষকদের ক্লাসে প্রশ্ন করতো, তখন ভালোভাবে পড়াশোনা করে না আসলে শিক্ষকদেরও বেশ চিন্তায় পড়তে হতো।  


তখন থেকেই ভাবতাম ও এত কি করে জানে? রহস্যটা আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করেছিলাম। দীঘাতে আমরা সবাই এক ঘরে ডরমিটরিতে ছিলাম ৷ আনন্দ আমাদের চারজনকে বলল, কাল ভোর চারটেয় কিন্তু আমাদের বেরোতে হবে ৷ মোহনার দিকে আগে যেতে হবে ৷ আমরা সেইমতো উঠে পড়ি এবং চার বন্ধু বেরিয়ে পড়ি মোহনার দিকে ৷ আমাদের হাতে কোদাল, সাবল, সাঁড়াশি, ছোট কুড়ুল ইত্যাদি। সেই সঙ্গে কিছু বোতল এবং ফর্মালিন ছিলো ৷ 


কিছুদূর যেতে যেতে আনন্দ বলেছিল, একটু দাঁড়া। এখানে কিন্তু লিমুলাস (রাজ কাঁকড়া) পাওয়া যাবে ৷ কিছুক্ষণ কোদাল ও সাবল চালানোর পর সত্যিই আমরা লিমুলাস পেলাম ৬ টি। অন্যান্য বিরল প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী বা স্পেসিমেন পেয়ে গেলাম ৷ উল্লেখ্য, যোগ্য প্রাণী ছিল– হিপাক্যাম্পাস বা সমুদ্র ঘোড়া, বেশ কয়েকটি নেরিস, আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্পেসিমেন। আমাদের ফিরে আসতে প্রায় ন'টা ৷ শিক্ষকেরা ভীষণ রেগে গেছেন আমাদের ওপর ৷ আসলে দুশ্চিন্তা থেকেই এই রাগ ৷ 


প্রফেসার ডঃ ইউসুফ আলি জোয়ারদার আমাদের প্রশ্ন করলেন, 'আলাদা তো গেলে, তা কিছু স্পেসিমেন কি পেলে ?'‌ আনন্দ বললো, 'স্যার বেশ কিছু বিরল প্রজাতির প্রাণী পেয়েছি ৷'‌ নাম বলাতেই স্যারের আক্কেল গুড়ুম ৷ তখন উনি প্রশ্ন করলেন, কোন বিচে, কোথায়, কিভাবে ? স্যারদের রাগ তখন একদম জল।  আনন্দকে সেদিন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম ! তুই এসব বীচগুলি কি করে জানলি? কত গভীরে গেলেই বা ওদের পাওয়া যাবে? ও বলেছিল 'ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে দিঘাতে এসেছি, পুরীতে গেছি এবং বোম্বের ওখাতেও গেছি বহুবার। সে‌ইজন্য কোন বিচে কি পাওয়া যায়, সেগুলো আমি জেনে গেছি ছোট থেকেই।' 


ডাক্তারি ‌পড়ার সুযোগ পেয়েও তো ও পড়েনি। বালিগঞ্জ গভঃ স্কুল থেকে পাশ করে জুলজি অনার্স পড়তে এসেছিল ৷ অদম্য ইচ্ছাশক্তি কেউ দমন করতে পারে নি। এই শিক্ষাটা কিন্তু পারিবারিক। এই শিক্ষা কিন্তু একদিনে গড়ে ওঠে নি। দিনের পর দিন ইমারতের মত গড়ে উঠেছিল। সেদিন বুঝেছিলাম কেন আনন্দ হিস্টোলজি স্লাইডগুলি একবারে বলতে পারতো ৷ 


আসলে ওর বাড়িতে মাইক্রোস্কোপ ছিলো ৷ প্রতিটি স্লাইড বহুবার করে স্টাডি করেছে ৷ আর আমরা যারা সর্বহারার দল, তাদের প্রয়োজনীয় বই, খাতাই নেই। সেখানে স্লাইড, মাইক্রোস্কোপ তো দূরের কথা ৷ কলেজে বছরে একবার–দুবার ভিড়ের মধ্যে আইডেন্টিফিকেশন দেখালেও মনে রাখা কঠিন হতো ৷ অত টিস্যুর ভিড়ে তারা হারিয়ে যেত ৷ যেখানে প্রয়োজন সর্বদা অনুশীলন করা। যেটা পরবর্তী জীবনে বুঝেছি৷ 


আনন্দ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে পাশ করেছিলো ৷ আমাদের ব্যাচে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে প্রথম। আর সেবার প্রথম শ্রেণি একজনই পেয়েছিল ৷ তারপর জীবন যুদ্ধে ছিটকে যাই ৷ আর যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। এক সময় শুনেছিলাম ও নর্থ বেঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক ৷ আনন্দের বাবা ছিলেন জুলজি তে ডক্টরেট ৷ তিনি ছিলেন জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র ডেপুটি ডাইরেক্টর ৷ তিনি তাঁর সন্তানকে এই বিষয়টিকে বিশদভাবে ছোট থেকেই অনুধাবন করতে শেখান ৷ 

বন্ধুকে একটা অনুসন্ধিৎসু মন তৈরি করে দিয়েছিলেন ৷ তবে এই অনুসন্ধিৎসু মনটা বিজ্ঞানের জগতে নতুন দিগন্ত দেখাতে পারে ৷ মেধাবী হওয়ার রহস্য জিনের মধ্যে আছে, একথা মিড রিডলের জিনোম বই থেকেই জানা যায়। আবার সবটাই যে পারিবারিক শিক্ষা হবে, এমন কোনও মানে নেই ৷ কখনও কখনও গোবরে পদ্মফুল ফোটে ৷ 

একটি ছাত্রকে জানি সে নিতান্ত হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান ৷ সে লেখাপড়া শুরু করেছিল দুরন্ত গতিতে ৷ তাঁর গতি ছিল বোর্ড বা কাউন্সিলের প্রথম দশে। সমীক্ষার শর্তে একবার ওই ছাত্রটির বাড়িতে গেছিলাম ৷ দেখলাম, তার মা ভীষন শিক্ষা অনুরাগী ৷ কিন্তু ক্লাস ফাইভ–সিক্স পর্যন্ত পড়াশোনা তাঁর। তিনি তাঁর সন্তানের কাছে বসে থাকতেন একটা তালের পাখা হাতে নিয়ে ৷ রাত একটা, দুটো পর্যন্ত যতক্ষন না তার পড়াশোনা শেষ হয়। একটু গরম চা দিলে যদি ছেলের এনার্জি বাড়ে, সেইজন্য ছেলের সঙ্গে রাত জাগতেন ৷

এখানে যতটা হেরিডিটি, তার থেকে অনেক বেশি সংস্কৃতি এবং ইচ্ছাশক্তি কাজ করে। সেই ছাত্র মেধাবী হওয়ার কারণ হিসেবে কিছুটা হলেও তার মায়ের সদিচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া যায়৷ সন্তানকে পড়তে বলে নিজে টিভি সিরিয়াল নিয়ে বসলে, সেই মা সন্তানকে কি সঠিক পথে চলিত করতে পারছেন ? এটাই প্রশ্ন থাক ? নিজের ব্যর্থতাগুলি সন্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়া এক ধরনের অপরাধ ৷ নিজের বিন্দুমাত্র স্বার্থত্যাগ না করাও অপরাধের শামিল ৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন