Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

রবিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

বাংলায় শিক্ষাবিস্তার ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

 ‌

Ishwar-Chandra-Vidyasagar

বাংলায় শিক্ষাবিস্তার ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর 

   স্বপন ঘোষ 

ভারতে ইংরেজ রাজত্বে শিক্ষানীতির রকমফের আর ধরণধারণ নিয়ে জলঘোলা নিতান্ত কম হয়নি। ইংরেজ বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপ বদলালেও গোড়ার দিকে এদেশের শিক্ষা নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কোনও শিক্ষা পরিকাঠামোই তৈরি করা হয়নি। কলকাতা মাদ্রাসা বা বেনারস সংস্কৃত কলেজের মতো ইতিউতি উদ্যোগ ছাড়া কোনও সুপরিকল্পিত সরকারি পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি। 

চার্লস গ্রান্ট প্রথম কোম্পানিকে বোঝালেন যে, এদেশে প্রশাসন চালাতে গেলে ইংরেজি জানা এদেশি কর্মী প্রয়োজন। তাই ভারতে ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করতেই হবে। এরপরেই ১৮১৩ সালের সনদ আইনে কোম্পানি এদেশে শিক্ষার জন্য এক লক্ষ টাকা ব্যয় বরাদ্দ করে। সেই টাকার ব্যবহার নিয়েও লড়াই কম হয়নি। ইংরেজি শিক্ষায় না কি দেশীয় শিক্ষায় অর্থব্যয় করা উচিত, এই নিয়ে ইংরেজদের মধ্যেই বিভাজন দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আমলে সিদ্ধান্ত হয়, ইংরেজিই হবে সরকারি শিক্ষার মাধ্যম। 

১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড হার্ডিঞ্জের আমলে অবশ্য ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি ভারতীয়দের জন্য দেশীয় মাধ্যমে শিক্ষার লক্ষ্যে একাধিক স্কুল তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে 'হার্ডিঞ্জ স্কুল' নামে খ্যাত স্কুলগুলি বোর্ড অব রেভিনিউর হাত থেকে কাউন্সিল অব এডুকেশনের অধীনে চলে আসে। কিন্তু এই স্কুলগুলির চরম দীনদশা চলছিল। ইংরেজি শিক্ষায় চাকরি আছে, সামাজিক সম্মান আছে, এই ভাবনার বশবর্তী হয়ে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়তে পাঠানোর ব্যাপারে অভিভাবকদের অনীহা ক্রমেই বাড়ছিল। এই অবস্থায় কাউন্সিল অব এডুকেশনের সদস্য ফ্রেডারিখ জে হ্যালিডে বাংলায় শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ দেখান। 

১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১ মে হ্যালিডে বাংলাপ্রদেশের প্রথম ছোটলাট হন। হ্যালিডে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে চিনতেন এবং তাঁর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বাংলাপ্রদেশে দেশীয় শিক্ষাধারা প্রচলনের দায়িত্ব হ্যলিডে বিদ্যাসাগরমশাইকেই দেন। এই বিষয়ে হ্যালিডের মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে: '‌Pandit Iswarchandra Sharma is an uncommon man, who had shown great energy and zeal on the matter, and I should be well pleased to let him try an experiment, in the result of which he is greatly interested, and which I really think will succeed in his hands.'‌

বিদ্যাসাগরের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও অনেকেই তাঁকে এই দায়িত্বে দেখতে চাননি। কিন্তু হ্যালিডে কারও কথায় কান না দিয়ে বিদ্যাসাগরমশাইকেই দেশীয় বিদ্যালয়গুলির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের কথা। ২১ মে থেকে ১১ জুন- সংস্কৃত কলেজে তখন ছুটি। বিদ্যাসাগর ঘুরে এলেন গ্রাম-গ্রামান্তর : শিয়াখালা, রাধানগর, কৃষ্ণনগর, ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোণা, শ্রীপুর, কামারপুকুর, রামজীবনপুর, পাঁতিহাল। এসব গ্রামের মানুষজন আদর্শ বঙ্গবিদ্যালয়ের জন্য যথেষ্ট আগ্রহ প্রকাশ করলেন। হ্যালিডেও বিশ্বাস করতেন, বিদ্যাসাগরের মতো মানুষের সাহায্য ছাড়া এদেশে বাংলা শিক্ষাব্যবস্থায় সাফল্যেরআশা সুদূরপরাহত। 

হ্যালিডের তৎপরতায় বিদ্যাসাগর দক্ষিণ-বাংলার বিদ্যালয়সমূহের সহকারী ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হলেন। এই কাজের জন্য তাঁর ২০০ টাকা বেতন বরাদ্দ হয়। তারপর প্রস্তাবিত আদর্শ বঙ্গবিদ্যালয়গুলির জন্য শিক্ষক নির্বাচনের পালা। একটা মজার কাহিনী উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। 

বিদ্যাসাগর একবার একটা গ্রামের স্কুলে গেছেন। কথাবার্তা বলে দেখলেন, স্কুলের ছেলেরা অঙ্ক আর বাংলা ভালোই শিখেছে। কিন্তু উঁচু ক্লাশের ছেলেদের ভূগোলের বিদ্যা পরখ করতে গিয়েই বিদ্যাসাগর হতাশ হলেন। পৃথিবীর ক-রকম গতি আছে ? কোন গতির জন্য পৃথিবীর কত সময় লাগে ? ছেলেরা জবাব দিল-পৃথিবীর কোনও গতি নেই। পৃথিবী স্থির হয়ে আছে। সূর্যই বরং পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

সব ছেলেরাই যখন ভুল জবাব দিচ্ছে, তখন বিদ্যাসাগর ভাবলেন, তাহলে পণ্ডিতমশাই নিশ্চয়ই ভুল শিখিয়েছেন। বিদ্যাসাগর পণ্ডিতমশাইকে ছাত্রদের ভুল উত্তর প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দিলেন, সত্যি সত্যিই পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে নাকি! দেখে তো তা মনে হয় না! আর ঘুরছে ঘুরুক না ! পৃথিবীর ঘোরাঘুরি নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা করার দরকার কী ? 

বিদ্যাসাগর বুঝলেন, বাংলা শিক্ষা ব্যবস্থাকে যদি সফল করে তুলতে হয়, তবে প্রথমেই প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষকের। বিদ্যাসাগর শিক্ষক নিয়োগের জন্য সংস্কৃত কলেজে পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেল, অধিকাংশ পরীক্ষার্থীই উপযুক্ত নন। বিদ্যাসাগরের তত্ত্বাবধানে একটি নর্মাল স্কুল খুলে শিক্ষক-শিখনের ব্যবস্থা করা হল। ১৮৫৫এর ২২ আগস্ট থেকে ১৮৫৬ এর ১৪ জানুয়ারি, এই সময়ের মধ্যে বিদ্যাসাগর স্থাপন করলেন ২০ টি বিদ্যালয়। নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর- চার জেলার প্রত্যেকটিতে পাঁচটি করে বিদ্যালয়। 

এতদিন বিদ্যাসাগর ছিলেন 'সহকারী ইন্সপেক্টর', ভারত সরকারের নির্দেশে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে তিনি হলেন 'স্পেশাল ইন্সপেক্টর'। আদর্শ বঙ্গবিদ্যালয়গুলির সাফল্যের জন্য বিদ্যাসাগর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তিনবছর পর দেখা গেল তাঁর পরিশ্রম বিফল হয়নি। ছাত্ররা লেখাপড়ায় যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। সর্বত্র বিদ্যালয়গুলি সমাদৃত হচ্ছে। ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর নিজের গ্রামে একটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। 

শুধু ছেলেদের জন্য স্কুল তৈরি নয়, বিদ্যাসাগর বিশ্বাস করতেন, মায়ের শিক্ষা ছাড়া সন্তানের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে ড্রিঙ্কওয়াটার বিটন কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বও শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের ওপর অর্পিত হয়েছিল। বিদ্যালয়ের বালিকাদের গাড়ির দুপাশে বিদ্যাসাগর 'মহানির্বাণ তন্ত্র' র একটি শ্লোকাংশ- 'কন্যাপেবং পালনীয়া শিকণীয়াতিযত্নতঃ'‌-খোদিত করে দেবার ব্যবস্থা করেন। তবে কেবল বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের দায়িত্ব নিয়েই বিদ্যাসাগর থেমে গেলেন না। 

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১৫ মে- এই সময়ের মধ্যে বিদ্যাসাগর স্থাপন করলেন ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়গুলির জন্য তাঁর মাসিক খরচ হতো তৎকালীন ৮৪৫ টাকা। বিদ্যাসাগর সরকারি সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সাহায্য মেলেনি। সরকারী কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় বিদ্যাসাগর শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়েছিলেন। 

ছোটলাট হ্যালিডে তাঁকে চাকরি না ছাড়ার অনুরোধ করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের উত্তর ছিল: যে কাজে আনন্দ আর সম্মান নেই, সেই কাজ তিনি করতে রাজি নন। ৫০০ টাকা বেতনের সরকারী চাকরি এককথায় ছেড়ে দিয়ে কেবল বই বিক্রির টাকাকে সম্বল করে বিদ্যাসাগর প্রায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর তৈরি স্কুলগুলি চালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কারণ, তেজস্বী এই বাঙালি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমেই একটি জাতি স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পরে। শিক্ষাই জাতির আত্মমর্যাদার মূল ভিত্তি।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন