সমকালীন প্রতিবেদন : ধেয়ে আসছে চরম বিপদ। আর বাকি মাত্র ৭৯ বছর। ২১০০ সাল নাগাদ ডুবে যাবে ভারতের কম করে ১২ টি শহর। অন্তত তিন ফুট জলের তলায় চলে যাবে ওই শহরগুলি। এমনই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানীরা। যেভাবে উষ্ণায়ণ বাড়ছে, তাতে এই বিপদ অনিবার্য বলে মনে করছেন তাঁরা।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ১৯০১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সমুদ্রের জলস্তর ১.৩ মিমি করে বাড়ছিল। কিন্তু ২০০৬-১৮ সালের মধ্যে চালানো সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, গোটা বিশ্বে সমুদ্রের জলস্তর প্রতি বছর ৩.৭ মিমি করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, পৃথিবী জুড়ে যে দূষণ চলছে, তা কমানো না গেলে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে যাবে অনেকটাই। এই তাপমাত্রা সাড়ে চার ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে।
ভারতের যে ১২টি শহর চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে, সেগুলি হল গুজরাতের কচ্ছ উপকূল, ভাবনগর, তুতিকোরিন, পারাদ্বীপ, চেন্নাই, ম্যাঙ্গালোর, ভাইজাগ, কাণ্ডলা, ওখা, মরমুগাঁও, কোচি, বিশাখাপত্তনম। কলকাতার খিদিরপুরও নিশ্চিন্ত নয়। মার্কিন জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার বদ্বীপ অঞ্চলে এভাবে জলস্তর বাড়লে বিপদ দেখা দেবে পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অংশে। ফলে কলকাতাও মোটেই সুরক্ষিত নয়।
এদিকে, বরফের রাজ্য গ্রিনল্যান্ডে হু হু করে গলছে হিমবাহ। রিপোর্ট বলছে, ৬০ শতাংশের বেশি এলাকা জুড়ে বরফের চাদর গলছে। ইতিমধ্যেই হিমবাহের উপরিভাগের এক মিলিমিটার স্তরের বরফ গলতে শুরু করেছে। এর ফলে প্রতি ঘণ্টায় অন্তত এক হাজার কোটি টন বরফ গলে জল হয়ে মিশছে সমুদ্রে। গ্রিনল্যান্ডের আর্কটিক সাগরের বিশাল বরফখণ্ড একদিনে গলে গিয়েছে। সেই বরফ গলা জলের পরিমাণ এতটাই বেশি যে, তা ফ্লোরিডাকে ডুবিয়ে দিতে পারে। দুই ইঞ্চি জলের তলায় চলে যেতে পারে আমেরিকার এই অঙ্গরাজ্য। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ১৯৫০ সালের পর গত ২৮ জুলাই গ্রিনল্যান্ডের তৃতীয় বৃহত্তম বরফখণ্ডটি গলেছে। ২০১২ ও ২০১৯ সালে এইরকম আরও দু'টি বরফখণ্ড গলেছিল গ্রিনল্যান্ডে।
ডেনমার্কের আবহাওয়া সংস্থার বিশেষজ্ঞদের দাবি, শুধুমাত্র জুলাই মাসেই হিমবাহ গলে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টন জল গিয়ে মিশেছে আটলান্টিক মহাসাগরে। এই জলে এক মাসে সমুদ্রতল ০.১ মিলিমিটার বাড়ার শঙ্কা। সমুদ্রের জলস্তরের এই বৃদ্ধি আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। উষ্ণায়ণের জেরে যেভাবে গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলছে, তাতে সমুহ বিপদ। ঝড়ঝঞ্ঝা যেমন বাড়বে, তেমনই উপকূলের বহু এলাকা ডুবে যেতে পারে, এমনটাই আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা।
ভয়ঙ্কর খবর শুনিয়েছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা যত থাকে, তার চেয়ে জুলাই মাসে ২.১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল তাপমাত্রা। এটা ভয়াবহ অশনি সঙ্কেত। হাতে আর এক মুহূর্ত সময় নেই। অবিলম্বে উষ্ণায়ণ রুখতে হবে। কমাতে হবে কার্বণ নিঃসরণ। একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, গ্রিনল্যান্ডে এতটাই অস্বাভাবিক হারে বরফ গলছে যে, প্রায় ৭২ কিমি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বরফের পুরু চাদর গলে ১০ কিমির মতো কমে গিয়েছে। এই ঘটনা রীতিমতো চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে তাঁদের কপালে। বায়ুস্তরের উষ্ণতা বৃদ্ধি যে গ্রিনল্যান্ডের হিমবাহ গলনের অন্যতম কারণ, তা আগেই জেনেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এবার জানা গিয়েছে, বরফের চাদরের নিচে দিয়ে উষ্ণ জলস্রোত বয়ে যাচ্ছে। আর তারই জেরে হিমবাহের তলদেশ থেকেও বরফ গলতে শুরু করেছে। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে একটি উষ্ণ জলস্রোত ধেয়ে আসছে হিমবাহের চাইঁয়ের দিকে। সেটাই বরফ গলানোর কাজে খলনায়কের ভূমিকা নিচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, ১৯৯২ সালে যে গতিতে গ্রিনল্যান্ডে বরফ গলত, তার চেয়ে এখন অন্তত সাতগুণ বেশি গতিতে বরফ গলছে।সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘে পেশ করা হয়েছে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ রিপোর্ট। সেই রিপোর্টে দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হয়েছে। বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে ভারতকে। বলা হয়েছে, ভারতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাড়বে। দেখা দেবে বন্যা। হিন্দুকুশ পর্বতের হিমবাহ গলতে শুরু করবে। সমুদ্রতল বাড়বে। উপকূলের অনেক নিচু এলাকা ডুবে যাবে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, অন্যান্য মহাসাগরের তুলনায় ভারত মহাসাগর দ্রুত হারে উষ্ণ হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এক থেকে দুই ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে। এর জেরেই ভারতের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাবে। শুধু তাই নয়, পরিস্থিতি যা তাতে গোটা পৃথিবীর তাপমাত্রা খুব তাড়াতাড়ি দেড় ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে। দ্রুত এই তাপ হ্রাস করা জরুরি। গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ সম্পর্কেও সতর্ক করা হয়েছে। ভারতের পাশাপাশি উষ্ণায়ণ নিয়ে সজাগ করা হয়েছে চিন ও রাশিয়াকে। ২০১৯ সালে জার্মানির বন শহরে জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেইসময় বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, গত শতকের তুলনায় এখন হিমালয়ের হিমবাহ দ্বিগুণ হারে গলছে। ২০০০ সাল থেকেই দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর শতকরা একভাগ করে বরফ গলছে। এই গলনের পরিমাণ বছরে পাঁচ ফুটেরও বেশি। যে হারে হিমালয়ের হিমবাহ গলছে, তাতে অচিরেই হিমালয় সংলগ্ন হ্রদগুলি ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন