সিপিএমের 'ভুল' রাজনীতি আর কতদিন ?
সুস্মিতা সিংহ দে
বাংলার একুশের বিধানসভা নির্বাচন নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বহিরাগতদের হাতে 'সুনার বাংলা ' হবে, না বাংলার সংস্কৃতি, কৃষ্টি বজায় থাকবে এই প্রশ্ন উঠেছিল। মানুষ রায় দিয়ে বুঝিয়েছেন, 'সুনার বাংলা' নয়, সোনার বাংলা থাকুক বাঙালির হাতে। বাংলার মেয়ের হাতে। এতো গেল একদিক। আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, ৩৪ বছর শাসন করা সিপিএম তথা বামফ্রন্ট এবং তারও আগে বাংলার শাসক কংগ্রেসের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। এই প্রথম বিধানসভায় সিপিএম, কংগ্রেসের কোন বিধায়ক নেই। বামেদের ডাকা ব্রিগেড বড় আশা জাগালেও সিপিএমের দু হাত বাড়িয়ে মুসলিম ধর্মগুরু আব্বাসকে বুকে টেনে নেওয়া 'চোনা' ফেলেছিল। সেই ভুলের খেসারত সিপিএমকে পরতে পরতে দিতে হচ্ছে।
কেন এমন হাল হল সিপিএমের? দলের রাজ্য কমিটির বৈঠকে বিভিন্ন জেলার নেতৃত্ব তুলোধুনো করল রাজ্য নেতৃত্বকে। একদা চিরশত্রু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ঢোক গিলে মেনে নিলেও আব্বাসের আইএসএফের সঙ্গে জোট কোনমতেই মন থেকে মেনে নিতে চান নি প্রায় সব জেলার নেতা, কর্মী, সমর্থকরা। সাধারণ মানুষও ভালো চোখে নেন নি। এমন প্রশ্নও উঠেছিল– হিন্দু মৌলবাদকে ঠেকাতে সিপিএম শেষ পর্যন্ত মুসলিম ধর্মগুরুর হাত ধরল? এটাই কি সিপিএমের ধর্মনিরপেক্ষতা? ভোটের পর চারদিকের হাল দেখে সিপিএমের রাজ্য নেতারা কার্যত স্বীকার করছেন– এ তাঁদের মারাত্মক ভুল।
সিপিএমের ভুল রাজনীতি তো আজকের নয়। প্রয়াত জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে না দেওয়া ছিল ঐতিহাসিক ভুল। ২০১৯ এর লোকসভার ভোটে সিপিএমের ভোট পড়ল বিজেপিতে। বিজেপির আসন একলাফে হল ১৮। সংগঠনে যে ঘুণ ধরেছে, তা ধরতে না পারা ছিল সিপিএমের ভুল। এবারও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হয়েছিল, একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম। সিপিএম বিজেপিকে প্রধান শত্রু মনে না করে তৃণমূলকে করল প্রধান শত্রু। বিহার নির্বাচনের পর সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সর্বভারতীয় নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছিলেন, 'বিজেপির বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করতে হবে। বিজেপি হল প্রধান শত্রু।' কিন্তু বাংলার সিপিএম নেতারা তাঁদের সোশ্যাল মিডিয়ায় দীপঙ্করকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করলেন। এও বলা হল, নকশাল নেতা দীপঙ্কর মমতার দালাল।
কিন্তু বাংলার গ্রাম, শহরের সিপিএমের সাধারণ কর্মীরা–সমর্থকরা, এমন কী ব্লক ও বুথস্তরের নেতারা ভোট নিয়ে কী ভাবছেন, সেটি উপলব্ধি করার মতো ভাবনাচিন্তা সিপিএমের নেতৃত্ব করেন নি। রাজ্যের মানুষ ভোটের পর দেখলেন, নিজেদের জোটকে নয়, ভোট দিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থীকে। নির্ভর করেছেন মমতা ব্যানার্জির ওপর। তথ্য বলছে– ২০১৬ তে বাম বিধায়ক ছিলেন ৩২ জন। সেই ৩২ আসনের ২৩ টি পেয়েছে তৃণমূল। ৯ টি বিজেপি। কংগ্রেসের ৪৪ আসনের মধ্যে ২৯ টি তৃণমূল, ১৫ টি বিজেপি পেয়েছে। সংখ্যালঘু জেলা মুর্শিদাবাদের ভোট বরাবরই হয় সিপিএমের, নয় তো কংগ্রেসের ছিল। এবার কী হল? ২২ আসনের (২ টিতে ভোট স্থগিত) ১৮ টি তৃণমূলের দখলে এসেছে। সিপিএমের দুর্গ বলে চিহ্নিত নবগ্রাম, ডোমকলে আর লাল পতাকা নেই। প্রদেশ সভাপতি, লোকসভার কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরির নিজের জেলা, নিজের লোকসভা কেন্দ্র ধূলিসাৎ। মুর্শিদাবাদে বিজেপি যে দুটি আসন পেয়েছে, তা কংগ্রেসের ভুল রাজনীতির কারনে। এতে প্রমানিত, সিপিএম + কংগ্রেস + আইএসএফ জোট কখনোই বাংলার মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে নি। মানুষ ওই 'রঙধনু' জোটকে ভরসাই করতে পারেন নি। সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবারেও বাম ভোট বেশ কিছুটা রামের দলে গেছে। কিন্তু ২০১৯ লোকসভার ভোটের থেকে কম।
সিপিএম এবারে একঝাঁক তাজা, টগবগে তরুনকে প্রার্থী করেছিল। সবাই উচ্চ শিক্ষিত। সমাজ সচেতন। মানুষের সঙ্গে সহজেই মেশেন (যা সিপিএম নেতৃত্বের নেই)। কিন্তু এখানেও একটা ভুল করল সিপিএম। যুদ্ধের ময়দানে নামানোর আগে ময়দানকে দেখানো দরকার ছিল। আচমকা তাঁদের নিয়ে এসে যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে দেওয়া হল। মীনাক্ষী, ঐশিদের মতো লড়াকুদের বক্তব্য সাধারণ মানুষের মনকে ছুঁয়ে গেল। সাড়াও ফেলে দিলেন। কিন্তু ভোটের ময়দান বলে অন্য কথা। ভোট করতে লাগে সংগঠন। সিপিএমের তাবড় নেতারা বুঝতেই পারেন নি, তাঁদের শক্তিশালী সংগঠন আর নেই। সংগঠনে ঘুণ ধরে গেছে। আসলে সিপিএম 'অপেক্ষামান সরকার' হয়েই ছিল। ২০১১ তে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর ২০২১ পর্যন্ত এমন কোনও আন্দোলন করে নি, যা দেখে মানুষ তাদের পাশে দাঁড়াবেন বা সরকারের ভিত নড়বড়ে হবে। দলের একটার পর একটা ভুল পদক্ষেপ, ভুল রাজনীতির কারনে মীনাক্ষীদের মাথা নীচু করে যুদ্ধের ময়দান ছাড়তে হয়েছে।
অতিমারি করোনার ভয়াবহতা বাংলা জুড়ে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেড ভলান্টিয়ারদের তাজা ছেলে– মেয়েরা মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। কখনও অক্সিজেন, কখনও খাবার নিয়ে হাজির করোনা আক্রান্তের দুয়ারে। সিপিএমের নেতৃত্ব কী এসব খোলা চোখে দেখছেন? নাকি 'অপেক্ষামান সরকারের' আশায় আলিমুদ্দিনের অলিন্দেই বসে আছেন। অন্তত, রেড ভলান্টিয়ারদের দেখে শিক্ষা নিন। নইলে একের পর এক ভুল রাজনীতির কারনেই সিপিএমের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুনবে, বাংলায় সিপিএম নামক একটি রাজনৈতিক দল ছিল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন