সমকালীন প্রতিবেদন : মহাকাশ থেকে পৃথিবীর পথে শুভাংশু শুক্লা। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে দিয়েছেন বিদায়ী বার্তা। ১৮ দিন কাটিয়ে প্রত্যাবর্তন। ২৮০০০ কিমি বেগে পৃথিবীতে নামবে শুভাংশুদের ক্যাপসুল! প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ কী ভাবে? কতটা ঝুঁকি আছে? ২৩ ঘণ্টার ফিরতি যাত্রা। পৃথিবীতে ফিরেও মা’য়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না শুভাংশু শুক্লা। কেন জানেন?
নাসা জানিয়েছিল, ভারতীয় সময় বিকেল ৪.৩০টা নাগাদ স্পেসএক্স-এর ড্রাগন ক্যাপসুল মহাকাশ স্টেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। সেই মতোই মহাকাশের আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন থেকে সোমবার বিকেলে পৃথিবীর দিকে ফিরতি যাত্রা শুরু করেন ভারতীয় মহাকাশচারী শুভাংশু শুক্লা এবং তাঁর সঙ্গীরা। তাঁদের অ্যাক্সিয়ম-৪ অভিযানের ‘আনডকিং’ প্রক্রিয়া শুরু হয় ঠিক বিকেল ৪টে ৩৫ মিনিটে (ভারতীয় সময়)। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে পৃথিবীতে ফেরার আগে শেষ বক্তব্যে আবেগঘন ভাষণ দেন ভারতীয় মহাকাশচারী গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্লা। তিনি বলেন, “আজকের ভারত মহাকাশ থেকেও আত্মবিশ্বাসী, নির্ভীক ও গর্বিত দেখায়। আজকের ভারত এখনও ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’। আমাদের মহাকাশ অভিযানের পথ হয়তো দীর্ঘ ও কঠিন, কিন্তু সেই যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে।”
হ্যাঁ, সব কিছু ঠিক থাকলে শুভাংশুরা পৃথিবীতে পৌঁছোবেন পরের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার। প্রায় ২৩ ঘণ্টার যাত্রা শেষে শুভাংশুদের নিয়ে ক্যালিফর্নিয়ার উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরে নামবে ক্যাপসুল। ভারতের ঘড়িতে তখন বিকেল ৩টে ১ মিনিট। সমুদ্রে মহাকাশযান অবতরণের প্রক্রিয়াকে ‘স্প্ল্যাশডাউন’ বলা হয়। এই সমগ্র প্রক্রিয়াটি আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা তাদের ওয়েবসাইটে সরাসরি সম্প্রচার করবে। কী ভাবে তাঁরা ফিরবেন, সেই সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যও দিয়েছে নাসা।
প্রথমত, যে ‘ড্র্যাগন’ মহাকাশযানে চড়ে শুভাংশুরা আইএসএস-এ গিয়েছিলেন, তাতে চড়েই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। সোমবার বিকেলে শুরু হয় ‘আনডকিং’। মানে শুভাংশুদের নিয়ে মহাকাশযানটি মহাকাশ স্টেশন থেকে আলাদা হবে। এই ‘আনডকিং’ প্রক্রিয়া স্বংয়ক্রিয় বা অটোমেটিক। তবে ভিতর থেকে নভশ্চরেরা প্রক্রিয়াটির দিকে নজর রাখেন।
দ্বিতীয়ত, আইএসএস থেকে আলাদা হওয়ার পরেই শুভাংশুদের ক্যাপসুল পৃথিবীর দিকে এগোতে শুরু করবে। এই সময়ে ক্যাপসুলের গতি কমানোর জন্য এক বার রকেট নিক্ষেপ করা হবে। একে বলে ‘রেট্রোগ্রেড বার্ন’। মহাকাশযানটি যাতে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণে প্রবেশ করতে পারে, তা নিশ্চিত করে এই ‘রেট্রোগ্রেড বার্ন’। তৃতীয়ত, যেখানে রিস্ক আছে তা হল, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে শুভাংশুদের ক্যাপসুল তীব্র তাপ এবং ঘর্ষণের সম্মুখীন হবে। এই সময়ে ক্যাপসুলের গতি থাকবে ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার। ধীরে ধীরে যা কমে আসবে ২৪ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়।
চতুর্থত, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর দু’টি প্যারাশুট খুলবে শুভাংশুদের ক্যাপসুল থেকে। প্রথমটি ছোট। তার ফলে গতি সামান্য কমবে। তার পর নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌঁছোনোর পরে খুলে যাবে মূল প্যারাশুটটি। নাসা জানিয়েছে, যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে, ক্যালিফর্নিয়ার উপকূলে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ধীরে ধীরে নামবে শুভাংশুদের ক্যাপসুল। সমুদ্রে অবতরণের পর স্পেসএক্সের একটি দল দ্রুত পৌঁছে যাবে শুভাংশুদের ক্যাপসুলের কাছে। ক্যাপসুলটিকে তারা তুলে নেবে জাহাজে। তার পর সেখানেই একে একে বেরিয়ে আসবেন নভশ্চরেরা। মহাকাশ থেকে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছেন শুভাংশুরা। ড্র্যাগন মহাকাশযানে থাকছে ২৬৩ কিলোগ্রামের বাড়তি জিনিসপত্র। মহাকাশে নাসার ৬০-এর বেশি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষার তথ্য এবং হার্ডওয়্যার শুভাংশুদের সঙ্গে থাকবে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ জুন স্পেসএক্সের ‘ড্রাগন’ মহাকাশযানে চড়ে আইএসএসের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন শুভাংশু। তাঁর সঙ্গে গিয়েছেন অ্যাক্সিয়ম-৪-এর ক্রু-কমান্ডার পেগি হুইটসন, মিশন বিশেষজ্ঞ স্লাওস উজানস্কি-উইজ়নিউস্কি এবং টিবর কাপু। ১৮ দিন মহাকাশে কাটানোর পর তাঁরা ফিরছেন। শুভাংশু আইএসএস-এ যাওয়া প্রথম ভারতীয়। তাঁকে নাসার অভিযানের সঙ্গে মহাকাশে পাঠানোর জন্য ৫৫০ কোটি টাকা খরচ করেছে ইসরো। উল্লেখ্য, ৪১ বছর আগে রাকেশ শর্মা মহাকাশে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতকে মহাকাশ থেকে কেমন দেখায়। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের পরে এই প্রথম কোনও ভারতীয় আবার মহাকাশ থেকে ভারতের ছবি তুলে ধরলেন, এক নতুন ভাবনায়, এক নতুন আত্মবিশ্বাসে।
ইতিমধ্যেই মহাকাশে ইতিহাস লিখছে ছেলে। এবার ঘরে ফেরার পালা। সেই অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন শুভাংশু শুক্লার পরিবার। কিন্তু পৃথিবীতে ফিরেই সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাড়িতে ফিরতে পারবে না শুভাংশু শুক্লা। ইসরো জানিয়েছে, পৃথিবীতে ফিরে শুভাংশুকে ৭ দিনের জন্য রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। শুধুমাত্র যে শুভাংশুকে এই রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তাই নয়। তাঁর সঙ্গে তিন নভোশ্চরকেও এক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তারপরেই তাঁরা দেখা করতে পারবেন নিজের পরিবারের সঙ্গে। প্রসঙ্গত, এই রিহ্যাবিলিটেশনের পিছনে রয়েছে বড় কারণ। এত দিন মহাকাশে মাধ্যাকর্ষণ শূন্য অবস্থায় ঘোরাফেরা করেছেন শুভাংশুরা। পৃথিবীতে ফিরে আবার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়া এবং হাঁটাচলা করতে ও ভারসাম্য ফেরানোর জন্যই এই বিশেষ প্রোগ্রাম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন