সমকালীন প্রতিবেদন : ভারতীয় রেলের ইতিহাসে নতুন মাইলস্টোন। প্রথমবারের জন্য সফলভাবে সম্পন্ন হলো হাইড্রোজেন চালিত ট্রেনের কোচ পরীক্ষণ। এই যুগান্তকারী ট্রেনটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে চেন্নাইয়ের ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরিতে। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব নিজেই এক্স হ্যান্ডেল–এ এই পরীক্ষার ভিডিও শেয়ার করে খবরটি ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী আগস্টের শেষ নাগাদ বাণিজ্যিকভাবে এই হাইড্রোজেন ট্রেন চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই অত্যাধুনিক ট্রেন প্রযুক্তির কেন্দ্রে রয়েছে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল সিস্টেম। হাইড্রোজেন গ্যাসকে সংরক্ষণ করা হয় ট্রেনের বিশেষ উচ্চচাপযুক্ত ট্যাঙ্কে। পরে সেই হাইড্রোজেন বাতাস থেকে সংগৃহীত অক্সিজেনের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে তৈরি করে বিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ সংরক্ষিত হয় ব্যাটারিতে এবং সেখান থেকে ট্রেনের চাকার সঙ্গে যুক্ত ট্র্যাকশন মোটরে পাঠানো হয়। এর ফলে চালিত হয় ট্রেনটি।
পরিপূরক শক্তির জন্য ট্রেনটিতে থাকবে ব্যাটারি সাপোর্ট সিস্টেম, যা চড়াই বা ভারী চাহিদার সময় অতিরিক্ত শক্তি জোগাবে। আবার নিম্ন চাহিদার সময় সেই ব্যাটারিগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ হবে, তৈরি করবে একটি স্থায়ী ও দক্ষ বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। রেল সূত্রে জানা গেছে, হাইড্রোজেন চালিত এই ট্রেন দেখতে সাধারণ ইএমইউ লোকাল ট্রেনের মতো হলেও প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক এগিয়ে। ঘণ্টায় ১১০ কিমি গতিতে চলতে সক্ষম এই ট্রেন। থাকবে মোট ৮টি কামরা এবং দুটি হাইড্রোজেন চালিত ইঞ্জিন, যেগুলি সামনের ও পিছনের দিক থেকে ট্রেনটিকে টানবে।
প্রাথমিকভাবে নর্দান রেলওয়ের জিন্দ-সোনিপত রুটে এই ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। চেন্নাইয়ের ভিলিভাক্কামে ১,২০০ হর্সপাওয়ারের ক্ষমতাসম্পন্ন এই ট্রেনের ট্রায়াল রান করা হবে বলে জানানো হয়েছে। ইন্টিগ্রাল কোচ ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার সুব্বা রাও জানান, “প্রথম পর্যায়ে ড্রাইভিং পাওয়ার কারের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় পাওয়ার কারের ট্রায়াল হবে। এরপর পুরো ট্রেনটি ট্রায়ালের জন্য প্রস্তুত হবে।”
ডিজেল চালিত ট্রেনের বদলে হাইড্রোজেন প্রযুক্তির এই রূপান্তর শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত নয়, বরং একটি পরিবেশগত বিপ্লব। ডিজেল ইঞ্জিন যেখানে ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করে, সেখানে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের উপজাত শুধুমাত্র জলীয় বাষ্প। এর ফলে রেলপথ বরাবর বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। এই ‘পরিষ্কার জ্বালানি’ ব্যবস্থার মাধ্যমে রেলপথে স্বাস্থ্যকর বায়ুর গুণমান বজায় রাখা যাবে, বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ শহর ও শহরতলির জন্য যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৩ সালে রাজ্যসভায় রেলমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে ৩৫টি হাইড্রোজেন চালিত ট্রেন চালুর পরিকল্পনা করছে। একটি ট্রেন তৈরির আনুমানিক খরচ পড়বে প্রায় ৮০ কোটি টাকা এবং প্রতিটি রুটের পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে আনুমানিক ৭০ কোটি টাকা। পরিবেশ ও অর্থনীতির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই হাইড্রোজেন ট্রেন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এই ধারা সমাজের সব অংশে সমানভাবে উপকার বয়ে আনবে, যা কেবল রেল পরিকাঠামোর নয়, দেশের পরিবহন নীতির ক্ষেত্রেও এক ঐতিহাসিক পালাবদল। এই প্রকল্প ভারতীয় রেলের কার্বন নিঃসরণ কমানো ও টেকসই ভবিষ্যত গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে, যা ভারতের জলবায়ু কর্মসূচি এবং আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে সহায়ক হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন