Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৩

বনগ্রামের চিরুণী শিল্প

Hair-art

বনগ্রামের চিরুণী শিল্প

স্বপন ঘোষ 

বনগ্রামের চিরুণীশিল্পের ইতিহাস সুদীর্ঘ। অবিভক্ত ভারতে যশোরের চিরুণীর খুব নামডাক ছিল। শুধু বাংলা নয়, ভারতের নানাপ্রান্তে, এমনকি ভারতের বাইরেও যশোরের চিরুণীর ভালো বাজার ছিল। দেশভাগের পরে যশোর লাগোয়া বনগ্রামে চিরুণী শিল্প ক্রমশ এক সমৃদ্ধ হস্তশিল্পের রূপ ধারণ করে। একসময় বনগ্রামে তিন শতাধিক ছোট-বড় চিরুণী কারখানা  ছিল। বর্তমানে শ্রমিক ও উপযুক্ত বাজারের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও এখনও বনগ্রামে ১৩০টি সচল চিরুণী কারখানা রয়েছে।                      

 কারখানা : 

বনগ্রামের চিরুণী শিল্প একান্তই গৃহকেন্দ্রিক উৎপাদন একক- যাকে শিল্পের ভাষায় 'Domestic Handicraft Industry'‌ বলা চলে। মূলত পরিবারের কর্তা ও অন্যান্য সদস্যগণ এবং কিছু দৈনিক শ্রমিকদের নিয়ে এই কারখানার চলে। দৈনিক শ্রমিকরা মূলত দুই প্রকারের : 1) Apprentice বা শিক্ষানবিশ এবং 2) Journeyman বা ভ্রাম্যমান শ্রমিক। একটা কারখানা গড়ে তুলতে একখণ্ড জমি, মেশিন বসানোর মত উপযুক্ত  পরিকাঠামো, অন্ততঃ ১৫ লক্ষ  টাকা মূলধন এবং কাজ জানা 

কয়েকজন শ্রমিক প্রাথমিক অবস্থায় প্রয়োজন। একই কারখানায় কমপক্ষে পাঁচটি মেশিন বসাতে পারলে অর্থাৎ পাঁচজন শ্রমিকের একত্রে কাজ করার ব্যবস্থা করতে পারলে পরিকাঠামো ব্যয় ও বিনিয়োজিত মূলধন থেকে লাভের সুযোগ থাকবে। 

কারখানায় তিন ধরণের মেশিন ব্যবহার হয় - 

‌১) চিরুণীর দাঁত কাটা 

২) ছিদ্রকরা ও ডিজাইনের কাজ করা 

৩) পালিশের কাজ করা 

কারখানায় Industrial Electric Connection আবশ্যিক। 


কাঁচামাল  : 

বনগ্রামের চিরুণী শিল্পে একসময় হাতির দাঁত, হাড়, সেলুলোজ ইত্যাদি কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হতো। তবে এখন বাণিজ্যিকভাবে চিরুণী তৈরিতে প্রধানত পেট্রোলিয়ামের উপজাত দ্রব্য Polypropylene ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বনগ্রামে বিভিন্ন ধরণের কাঠ দিয়ে এখনও রকমারি চিরুণী তৈরি হয়। মুম্বই থেকে চিরুণী তৈরির উপযোগী Polypropylene শিট আমদানি করা হয়। তারপর সেগুলি কাটিং হয় এবং চাহিদামত চিরুণী তৈরি করা হয়।

শ্রমিক ও তাদের মজুরি  : 

বনগ্রামের চিরুণী শিল্পে যেসব শ্রমিকরা কাজ করেন, তাদের ১০০ শতাংশই অদক্ষ, প্রশিক্ষণহীন শ্রমিক। এই শ্রমিকেরা অনেকেই বংশানুক্রমিকভাবে এই পেশায় আছেন। কাজ করতে করতে তাদের কাজ শেখা। সীমান্তবর্তী শহর বনগাঁতে মাইগ্রেশন একটি দীর্ঘকালীন সমস্যা। সীমান্ত পার হয়ে আসা উদ্বাস্তুরা  অনেকেই চিরুণী শিল্পের শ্রমিক। 

কারখানার মালিকের  হিসাব অনুসারে,  একজন শ্রমিক দিনে গড়ে ৩০০০ চিরুণীর দাঁত কাটতে পারেন। ১০০০ চিরুণীর দাঁত কাটায় তার উপার্জন হয় কমবেশি ২০০ টাকা অর্থাৎ ৩০০০ চিরুণীতে দৈনিক গড়ে ৬০০ টাকা। কাজ করলে তবে টাকা- এই ভিত্তিতেই কারখানাগুলিতে কাজ হয়। 

শ্রমিকদের সংগঠন আছে। বনগ্রামের ১৩০টি চিরুণী কারখানায় প্রায় ২০০০ শ্রমিক কাজ করেন। তবে সংগঠন রাজনৈতিক দলাশ্রয়ী- শিল্প বা শ্রমিকদের গঠনমূলক উন্নয়ন এক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় না। শ্রমিকদের বীমা নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। পেনশনের ব্যবস্থা নেই।  

সমস্যা : 

বনগ্রামের এককালের সমৃদ্ধ চিরুণী শিল্প এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত : 

১) প্লাস্টিক বা রাবারের চিরুণী Polypropylene- এ তৈরি চিরুণীর চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে। 

২) শিল্প প্রসারণে সরকারি উদ্যোগের অভাব রয়েছে।

৩) রপ্তানির বাজার স্থিতিশীল নয়। 

৪) মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বুনিয়াদ সুদৃঢ় নয়- শ্রমিকরা স্থায়ীভাবে এক কারখানায় কাজ করেন না। 

৫) যন্ত্রপাতি পুরোনো আমলের। 

৬) প্রযুক্তি-নির্ভর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। 

৭) শিল্প-উদ্যোক্তাদের পুঁজি বেশ কম, পরিকাঠামোও একান্ত দুর্বল। 

ফলে একদা সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যশালী শিল্প গত ১০০ বছরেও গৃহকেন্দ্রিক উৎপাদনের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেনি। বরং ক্ষয়ের চিহ্ন তার সর্বাঙ্গে। ‌



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন