ব্ল্যাক ডায়মন্ড — পর্ব-১
অজয় মজুমদার
কয়লাকে ইংরেজি ভাষায় কখনো কখনো আদর করে বলা হয় ব্ল্যাক ডায়মন্ড। কারণ, হীরে বা ডায়মন্ড আসলে সবটাই কার্বন। আর কয়লাতেও কার্বনের পরিমাণটা খুবই বেশি। প্রকৃতপক্ষে কয়লা হল উদ্ভিজ জিবাশ্ম। পৃথিবীতে হীরের যেমন আদর, কয়লার আদর তার থেকে বেশি ছাড়া কম নয়।
অবশ্য দুটির আকর্ষণ বিভিন্ন ধরনের৷ মানুষের কাছে শুধু প্রয়োজনীয় পদার্থ হিসেবে কয়লাও একটা রত্ন। আধুনিক সভ্যতায়, শিল্প গড়ে ওঠার প্রধান ভিত্তি। আর এই 'কালোমানিক' নামটা কয়লার আদরের নাম হতেই পারে।
কয়লা যে মানুষের আদরের জিনিস হয়ে উঠেছে, সেটা খুব প্রাচীন যুগের ব্যাপার নয়। কয়লার ব্যবহারটাই মানুষের সভ্যতার অনেক পরের দিকে শুরু হয়েছে। ঠিক কোন যুগে মানুষ এর ব্যবহার শুরু করল, তা আজ বলা শক্ত। তবে কয়লা জ্বালিয়ে যে তাপ পাওয়া যায়, আদিম যুগেই মানুষ তা জানতে পেরেছিল৷
কিন্তু কয়লার ব্যবহার শুধু হয় অনেক পরে। সভ্যতার কালের হিসাবে দেরি করে কয়লার ব্যবহারের একটা কারণ বোধহয় মানুষের কাছে প্রচুর শুকনো কাঠ সুলভ ছিল বলেই। কয়লার নানারকম গুণ এবং সুবিধার কথা মানুষ জানতে পেরেছে ক্রমে ক্রমে। আর কয়লার ব্যবহারও তাই ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে।
খ্রীস্টিয় যুগ শুরু হবার আগেই কয়লার ছাইকে রোমানরা রাস্তা তৈরীর কাজে ব্যবহার করেছে, তার প্রমাণ আছে। পাথর থেকে ধাতু গলিয়ে বার করার কাজে কখনো কখনো কয়লাকে মানুষ ব্যবহার করেছে।
ভারতে কয়লা খনি অঞ্চলের কিছু কিছু সংস্কৃত নাম ইঙ্গিত দেয় যে, প্রাচীন ভারতে কয়লাকে খনিজ বলে মনে করা হতো৷ যেমন আমরা জানি, বড়াকর অঞ্চলে কয়লা খনি আছে৷ সংস্কৃতে(বর+ আকর) 'বরাকর' অর্থে ভালো খনি বোঝায়৷
খনিজ পদার্থ হিসেবে বুঝলেও কয়লার ব্যবহারের চলন এদেশে কিন্তু ইউরোপের পরে৷ ইংল্যান্ডে নবম শতাব্দীতে খনি থেকে কয়লা তোলা হতো। ইউরোপের অন্যান্য কয়লা খনি অঞ্চলেও দশম শতাব্দী থেকে কয়লা তোলার তথ্য পাওয়া যায়।
সাধারণ মানুষের কাছে কয়লা এই সময় থেকেই নানা রকম উৎসুক্যের সৃষ্টি করে৷ বিশেষত জ্বালানি হিসেবে৷ ইউরোপে মধ্যযুগে লোহা গলানো ও অস্ত্র তৈরীর কাজ ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর এ কাজে প্রধানত কয়লাই ব্যবহার করা হতো।
কয়লার খুব বেশি ব্যবহারের পক্ষে একটা বড় রকমের বাধা ছিল পরিবহনের অসুবিধা৷ কয়লা হয়তো পাওয়া গেল জনমানুষের বসতি থেকে দূরে জঙ্গলে বা পাহাড়ে, যেসব জায়গায় পথ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্গম।
তাছাড়া, দূর দূরান্তে মানুষের বসতি এলাকার কয়লা পৌঁছে দেওয়া আজকের যুগে এটা বড় সমস্যা না হলেও মধ্যযুগের একটা বড় রকমের সমস্যা ছিল৷ কয়লার মতো ভারী জিনিসের পরিবহন চলতো কেবল জলপথে নৌকা বা জাহাজে।
মনে রাখতে হবে যে, সেই সময়ে স্থলভাগের রাস্তাঘাটও আজকের চেয়ে কম ছিল। শুধু জলপথে একটা জিনিসের প্রসার কতটুকু হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এইসব কারণেই কয়লা ব্যবহারের প্রসার ঘটেছে খুব ধীরে ধীরে৷
ব্যাপকভাবে কয়লার ব্যবহার শুরু হল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে৷ স্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কার, আর সেই সঙ্গে নানারকম কলকারখানা চালু হওয়ার ফলে কয়লার ব্যবহার গেল দারুনভাবে বেড়ে। জাহাজে স্টিম ইঞ্জিন চালানোর জন্যও যেমন কয়লার খরচ হতে লাগলো, তেমনি দ্রুতগামী জাহাজে কয়লার পরিবহনে সুবিধাই হল।
এরপর স্থলপথে রেল গাড়ি চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়লার ব্যবহার আরও বেড়ে গেল৷ সেই সঙ্গে সভ্য জগতে চাহিদা বেড়ে চলল লোহা ও ইস্পাতের, যা তৈরি করতে কয়লা একটি অপরিহার্য দ্রব্য৷ এইভাবে কদর বাড়তে বাড়তে কয়লা আজ আমাদের কাছে আদরের কালো মানিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন