বিশ্বজিৎ কর্মকার
প্রায় ছ’ মাস ধরে টিনা ঠিক মতো ঘুমতে পারছে না। ঘুমতে গেলেই ওর মাথায় উদ্ভট এক চিন্তা এসে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। টিনা এখন বি.এ.ফার্স্ট ইয়ার। কলেজে ওর যেতে ইচ্ছে করে না, চেহারার জন্য। ও যেন দেখতে কেমন হয়ে গেছে। আগে সব ছেলেরাই ওকে দেখতো। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুষ্টু মিষ্টি কথা বলতো। এখন কেউ ঘুরেও তাকাতে চায় না। ও নিজেই বুঝতে পারে, সেই টিনা এখন আর নেই।
ওর প্রিয় বান্ধবী রিয়া এক দিন বলেছিল, ‘তোর চেহারাটা এরকম কেন হয়ে গেছে বলতো। বুড়িদের মত হাড় ছাড়া আর তো কিছুই নেই। তোর প্রেমিক কি তোকে ল্যাঙ মেরেছে নাকি?’
রিয়ার কথা অসহ্য লেগেছিল ওর। এখন আর কারো সাথেই কথা বলতে ভালো লাগে না। সবাই শুধু চেহারা নিয়ে কথা বলে। ওর মা বাবা তো আরো উৎকণ্ঠিত হয়ে, আছে মেয়েকে নিয়ে। বাবা মায়ের এই একই মেয়ে। এরকম দেখতে হলে তো কেউ ওকে বিয়ে করবে না। প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহে ডাক্তার চেঞ্জ করে তারা। কিন্তু কোন উপকার নেই। টিনার শরীর যেরকম ছিল সেরকমই আছে। বরং আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রত্যেক ডাক্তারই ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। ওষুধ খেলে ঘুম হয় ঠিকই কিন্তু এক বার ভেঙে গেলে আর ঘুম আসে না। সারারাত একা সারা বাড়ি পায়চারি করে বেড়ায়। সে যে কি যন্ত্রণা, তা কাউকে বোঝাতে পারে না।
আসলে টিনাকে গ্রাস কছে একটা ভয়। একদিন দাঁত ব্রাস করতে গিয়ে ও হঠাৎ দেখতে পায়, ওর মাড়ির পাশে একটা মাংস পিণ্ড। ও তারপর সেই মাংস পিণ্ডটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। হ্যাঁ ঠিকই দেখেছে ও। চোখের ভুল নয়। টিনার মনে হয় ওর মাড়িতে টিউমার হয়েছে। সেই থেকে ভয়ে ওর ঘুম উধাও হয়ে গেছে।
একদিন ভয়ে শুকনো গলায় মাকে বলেছিল, ‘মা আমার টিউমার হয়েছে মুখে’।
ওর মা মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘চিন্তা করিস না। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো’।
সেই থেকে ডাক্তারের বাড়ি টিনার যাতায়াত। সব ডাক্তারই বলেছে, ‘ওটা টিউমার নয়। ওটা ছিলই, টিনা দেখেনি এতদিন। ও হঠাৎ আবিষ্কার করেছে’।
সব ডাক্তারই প্রায় একই কথা বলেছে। কিন্তু কোন ডাক্তারের কথাই টিনার পছন্দ হয়নি। ওর মনে হয় সব ডাক্তারই কিছু না কিছু লুকিয়ে রাখছে, ওকে ঠিক বলছে না। ওর মনে হয়, ‘কেন সবাই আমার সঙ্গে এরকম করছে। আমি কি অন্যায় করেছি, যে সবাই আমাকে মিথ্যে বলছে’।
আগে ঘরে একা থাকলে গুন গুন করে গান শুনতো, না হলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে সাজতো অনেকক্ষণ ধরে। এখন এসব ও করে না। কিছুই ওর ভালো লাগে না। ও এখন একা থাকলেই হা করে মুখের ভিতরের মাংস পিণ্ডটা দেখে। সারা ঘরে ওর জামা কাপড় এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে থাকে, গুছিয়ে রাখে না। মায়ের সঙ্গে গিয়ে টিভি দেখে না। ইচ্ছে করে না কিছু। ইচ্ছেটা কেমন যেন মরে গেছে।
একদিন কাউকে না জানিয়ে একা একা গিয়েছিল এক গনৎকারের কাছে। সে একটা তাবিজ দিয়েছে। বিনিময়ে এক হাজার টাকা নিয়েছে। আর বলেছে রোজ শিবের পুজো করতে। গনৎকারের কথা শুনে প্রতিদিন শিব পুজো করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, যে কে সেই। মনটা ভালোই হচ্ছে না। শিব ঠাকুরের পুজো দেবার সময়ও চোখের সামনে ভেসে উঠছে মাংস পিণ্ড।
অনেক দিন ও কলেজে যায়নি। বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে এখন আর ভালোলাগে না। ওরা কত আনন্দ করে, কত মজা করে। টিনার জীবনের সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে ওই মাংস পিণ্ড। ও যেন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো একা হয়ে গেছে। ও জানে এভাবে থাকা যায় না। কিন্ত কি করবে, কিছুতেই ও সহজ হতে পারছে না।
এক রাতে একা একা রাত তিনটের সময় ছাদে চলে গিয়েছিল। বাইরের বাতাস ভালো লাগছিল, তবু আনন্দ ফিরিয়ে দিতে পারেনি। বরং ওর মনে হচ্ছিল, এই ভাবে বেঁচে থেকে কি হবে। ছাদের থেকে লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল। মা বাবা একা হয়ে যাবে, আর কোন ভাই বোন নেই বলে ও আত্মহত্যা করতে পারছে না। কিন্তু মা বাবাকে ও কিছুতেই বোঝাতে পারছে না, ‘আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি মরতে চাই’। একথা তাদের কোন দিন বলতে পারবে না। ওদের অসহায় মুখ দেখলেই ভিতরে ভিতরে কষ্ট হয়।
পরের দিন আর নিজেকে আটকাতে পারে না টিনা। মায়ের কাছে একেবারে ভেঙে পড়েছে। মাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমি আর বাঁচবো না মা।
মা টিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘কি হয়েছে তোর বল?’
‘আমার ক্যান্সার হয়েছে’।
‘মানে!’
‘হ্যাঁ মা, আমার মুখে ক্যান্সার হয়েছে। ওই যে ভিতরে মাংসের পুঁটলি, ওটা ক্যান্সারেরই লক্ষণ’।
মায়ের বুকটা কেঁপে ওঠে, তবু নিজেকে শক্ত করে বলে, কোন ডাক্তার বলেছে তোকে?
‘না, কোনও ডাক্তার বলেনি। সব ডাক্তারই তো ওটা লুকিয়ে রেখেছে। কেউই তো সত্যি কথা বলছে না আমার সাথে। আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। তোমাদের জন্য আমি কিছু করতে পারলাম না। আমি তোমাদের অযোগ্য মেয়ে’। টিনা বেশ জোরে কেঁদে ওঠে’।
মা স্নেহের পরশ দিয়ে বলে, ‘তুই একটা বোকা’। বাবা পাশের ঘর থেকে এসে বলে, ‘কি হয়েছে? ও কাঁদছে কেন?’
দেখ না ও বলছে, ‘ওর নাকি মুখে ক্যান্সার হয়েছে। ও নাকি বাঁচবে না’।
বাবা টিনার পাশে বসে মাথায় হাত দিয়ে বলে, ‘কিচ্ছু হয়নি মা তোর। ডাক্তার বাবুরা তো বলেছেন’।
এমন সময় দরজায় কলিং বেলের শব্দ। বাবা গিয়ে দরজা খোলে। দেখে টিনার বান্ধবী রিয়া এসেছে। টিনাকে কাঁদতে দেখে ও ঘাবড়ে যায়। হঠাৎ কি বলবে বুঝতে পারে না। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে, ‘কিরে, কি হয়েছে বল তো?’
টিনার মা বলে, ‘বসো মা। জান তো ও বলছে, ওর নাকি মুখে ক্যান্সার হয়েছে’।
রিয়া বলে, ‘তুই কি করে বুঝলি, তোর ক্যান্সার হয়েছে? তুই কি ডাক্তার?’
রিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে টিনা বলে, ‘আমি মরে গেলে বাবা মাকে একটু দেখিস’। টিনা হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে। রিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমি তো কোন দিন মদ, গুটখা, সিগারেট খাইনি। আমারই মুখে ক্যান্সার হল’।
রিয়া বুঝতে পেরেছে, ওর বান্ধবীর রোগটা শরীরের নয়, মনের। ওকে গ্রাস করেছে মৃত্যু ভয়। কিছুদিন আগে ওদের কলেজে একটা সেমিনার হয়েছিল মানসিক রোগ নিয়ে। সাইক্লজিস্ট, সাইক্রিটিস্টরা সুন্দর ভাবে মানসিক রোগ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেই আলোচনা থেকে ও বুঝতে পেরেছে, টিনার মানসিক রোগ হয়েছে।
রিয়া বলে, ‘মাসিমা–মেসোমসাই একটু ওঘরে চলুন, একটা কথা বলবো।’
পাশের ঘরে এসে রিয়া বলে, ‘মাসিমা–মেসোমসাই জানেন তো টিনার শরীরে কোনও রোগ হয়নি। ওর রোগ মনে। ওর দেখবেন কিছুই হয়নি। ওকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে’।
‘কি সব বলছো মা, আমার মেয়ে পাগল হয়ে গেছে? শেষ পর্যন্ত পাগলের ডাক্তারের কাছে নিতে হবে?’
‘মাসিমা ওভাবে বলবেন না। শরীরের রোগটাও যেমন একটা রোগ। মনেরটাও সেরকম। এরও চিকিৎসা আছে। ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। ওসব পাগল-টাগল বলবেন না। ওসব পুরনো ধ্যান ধারনা’।
টিনার বাবা বলে, ‘ঠিক আছে অনেক তো দেখলাম। তোমার কথা না শোনার তো কিছু নেই। তুমি যোগাযোগ করো। তুমি নিয়ে যেও। আমরা যেতে পারবো না’।
টিনার মা বলে, ‘শোন মা, কাউকে যেন বলো না, ওকে পাগলের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। বয়েস তো হচ্ছে। এসব শুনলে কেউ আবার বিয়ে করতে চাইবে না’।
রিয়া হেসে ফেলে ওদের দুজনের কথা শুনে। বলে, ‘ঠিক আছে। চলুন ঘরে টিনার সাথে কথা বলি’।
টিনার মা বলে, ‘তুমি গিয়ে গল্প করো। আমি একটু তোমাদের জন্য খাবার তৈরি করি’।
রিয়া ঘরে ঢুকে দেখে, টিনা উদাস ভাবে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। রিয়া ঘরে ঢুকেছে তা নিয়ে ওর কোনও উৎসাহ নেই। এতক্ষণ রিয়া ওর বাবা মায়ের সাথে কি কথা বলল, তা শোনার জন্য কোন আগ্রহ নেই।
রিয়া টিনার পাশে বসে বলে, ‘তোকে আমি একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, যাবি তো’?
এবার যেন একটু উৎসাহ পায়। বলে, ‘ক্যান্সার সারাতে পারবে তো’?
রিয়া হেসে বলে, ‘উনি তো ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ’।
টিনার একটু ভালো লাগে, যেন সাহস পায়। বলে, ‘তুই তাড়াতাড়ি যোগাযোগ কর। আমি বাঁচতে চাই রিয়া। প্লিজ তুই আমাকে হেল্প কর’।
রিয়া টিনাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে’।
--------------------------
অসাধারণ লাগল। ঠিক যেন মনে গেঁথে গেল।👌
উত্তরমুছুন