Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

বুধবার, ১১ আগস্ট, ২০২১

জ্বলছে আফগানিস্তান, কেমন আছে পরিবার ? কলকাতায় থাকা কাবুলিওয়ালাদের মন পড়ে স্বদেশে

 

Afghanistan-is-burning

সমকালীন প্রতিবেদন : '‌আমি যখন গোলগাল, হাসিখুশি মিনির জন্য বাদাম, আখরোট, কিসমিস নিয়ে আসি, সেটা আসলে মিনির জন্য আনি না। নিয়ে আসি সেই মেয়েটার জন্য, যাকে ফেলে এসেছি ওই পাহাড়ের কোলে। কে জানে, কেমন আছে আমার মেয়েটা।'– মনে পড়ে সেই গল্পটা ! ১৮৯২ সালে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই গল্পের হাত ধরেই পাঠকের ঘরে ঢুকে পড়ে কাবুলিওয়ালা। চেহারায় স্বতন্ত্র। তীক্ষ্ণ চোখ। রুক্ষ চেহারা। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরনে।

কাবুলিওয়ালা অর্থাৎ কাবুলের মানুষ। কয়েক দশক ধরে পেশার টানে এই কাবুলিওয়ালাদের অনেকেই রয়ে গিয়েছেন শহর কলকাতায়। প্রথমদিকে নিজেদের দেশ থেকে আনা মশলা, শুকনো ফল, খুবানি, পোস্ত আর আতর ফেরি করে বেড়াতেন। কিন্তু দিন বদলেছে। ধীরে ধীরে অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছেন কাবুলিওয়ালারা। অনেকের এখন বড়বাজারে দর্জির দোকান। কেউ কেউ আবার টাকা সুদে খাটান। সবমিলিয়ে তিলোত্তমা কলকাতায় হাজার পাঁচেক কাবুলিওয়ালা রয়েছেন।

ঘর ছেড়ে কয়েক হাজার মাইল দূরে থাকা এই কাবুলিওয়ালাদের আজ মন ভাল নেই। কারণ, স্বদেশ জ্বলছে। অশান্ত জন্মভূমি। তালিবানরা একের পর এক মোবাইল টাওয়ার ভেঙে দিচ্ছে। ফলে ফোনে যোগাযোগের সুযোগটুকুও মিলছে না। খবরের কাগজ আর টিভির নিউজ চ্যানেলে চোখ রেখে অজানা আশঙ্কায় শিউড়ে উঠছেন তাঁরা। বাড়িতে মা, বোন, স্ত্রীরা ঠিক আছেন তো ? ওঁদের যেন কিছু না হয়, উপরওয়ালার কাছে একটাই প্রার্থনা।

কলকাতার সঙ্গে কাবুলিওয়ালাদের আত্মিক যোগাযোগ অনেক দিনের। বহু বছর ধরে বাস করতে করতে কখন যেন এই শহরটাও ওঁদের নিজের হয়ে গিয়েছে। কাশীপুরে তৈরি হওয়া সংগঠন খোদা-ই-খিদমৎগারের সভাপতি আমির খান। বলেছেন, রোজই অশান্তির খবর পাচ্ছি। আফগানিস্তানে এখন ফসল ওঠার সময়। তা বিক্রি করতে হবে। কিন্তু তালিবানদের অত্যাচারে বহু মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। শান্তি চান তাঁরা। চান, সুখে থাকুক তাঁদের পরিবার। বড়লোকদের হয়তো কোনও সমস্যা হবে না। তাঁরা চাইলে অন্য দেশে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু গরিবরা। প্রশ্ন আমিরের। বললেন, দেশের জন্য সবারই মন খারাপ। একটিবার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই অবস্থায় তা কীভাবে সম্ভব!

আফগানিস্তানে পড়ে থাকা পরিজনদের জন্য রাতে বিছানায় শুয়েও দু'চোখের পাতা এক করতে পারছেন না শহরের কাবুলিওয়ালারা। মোবাইলে কিংবা ফেসবুকে প্রাণের প্রিয় মানুষগুলির ছবি দেখতে দেখতে বুজে আসছে গলার স্বর।

কলকাতার চাঁদনিচকের গলি ধরে ইলেকট্রনিক্সের দোকানগুলি একের পর এক পার করে এসে চোখে পড়বে একটি হোটেল। নাম সাবিরস হোটেল। বলা হয়, কলকাতায় এরাই নাকি প্রথম চিকেন রেজালা চালু করেছিল। এই হোটেলে ঢুকলেই মনে হবে যেন এক টুকরো আফগানিস্তানে চলে এসেছেন। এখানকার মানুষের মুখের ভাষা বদলে গিয়েছে। আসলে তাঁরা নিজেদের মধ্যে পাস্তোতে কথা বলছেন। এটাই আফগানদের ভাষা। চোখে পড়বে পাঠানি পরা দীর্ঘদেহী কাবুলিওয়ালাদের। শুধু এখানেই নয়, শহর কলকাতায় আরও কয়েকটি জায়গায় কাবুলিওয়ালাদের আখড়া রয়েছে। ময়দানের যেদিকটায় ইসকনের রথ হয়, সেখানে গেলে দেখা যাবে প্রতিদিন বিকেলে কিছু আফগান যুবক ক্রিকেট খেলছে। এঁরা কাবুলিওয়ালাদের সন্তান। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। নিজেদের মধ্যে পাস্তোতে কথা বললেও এই আফগান যুবকরা হিন্দি বলতে পারেন। কেউ কেউ আবার বাংলা ভালই রপ্ত করেছেন।

৩৬ বছর ধরে কলকাতায় রয়েছেন রেহমাতুল্লাহ। এদেশে পা রেখে প্রথমে মুম্বই, পরে কলকাতায় আসেন। এই শহরের প্রতি তাঁর দারুণ টান। বললেন, এতগুলো বছর এখানে থাকলেও কেউ কোনওদিন আমায় জেরা করেননি। পরিবার নিয়েই থাকেন রেহমাতুল্লাহ। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। তাঁর কথায়, এখন রোজগার সেভাবে নেই। আগে টাকা সুদে খাটাতেন। এখন ব্যাঙ্ক থেকে সহজেই ঋণ মেলে। তাই ওই ব্যবসা চলে না। তা হলে পেট চলে কীভাবে ?‌ রেহমাতুল্লাহর কাছেই জানা গেল, শহরের কাবুলিওয়ালাদের অনেকে এখন কাজু, কিসমিসের ব্যবসা করেন। কেউ কেউ আবার কাপড়ের ব্যবসায় মন দিয়েছেন।

কলকাতার পার্কসার্কাস, ইলিয়ট পার্ক, তালতলা, ডানলপ, দমদম, বড়বাজার, কাশীপুর চত্বরে কাবুলিওয়ালাদের দেখা মেলে। পার্কস্ট্রিটে রহমানিয়া হোটেলে গেলেও কাবুলিওয়ালাদের দেখা মিলবে। পরিচয় ঘটবে তাঁদের খাবারদাবারের সঙ্গে। কিন্তু স্বদেশ নিয়ে চিন্তিত সকলেই। তালিবান সন্ত্রাসে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তাঁরা। রেহমাতুল্লাহ বললেন, আবার কি সেই দিন ফিরে আসবে ! মেয়েরা ঘর থেকে বের হতে পারবে না। নিজেকে কালো বোরখায় সারাক্ষণ আবৃত করে রাখতে হবে। মৃত্যু শয্যাতেও কোনও আফগান মহিলার চিকিৎসা করতে পারবেন না কোনও পুরুষ চিকিৎসক। কোনও মহিলা রোগীর চিকিৎসার জন্য শুধুমাত্র মহিলা চিকিৎসককেই ডাকতে হবে। যদি নিতান্ত কোনও পুরুষ চিকিৎসককে ডাকতে হয়, তাহলে সেই রোগীর নিকটাত্মীয়কে সঙ্গে রাখতে হবে। পুরুষ চিকিৎসক শুধুমাত্র মহিলা রোগীর সংক্রমিত উপাঙ্গই স্পর্শ করতে পারবে। শরীরের আর কোনও অঙ্গ দেখতে পারবেন না। মহিলা রোগীর নাম ধরে ডাকার জন্য মহিলাদেরই রাখতে হবে। যেখানে পুরুষ রোগী ভর্তি থাকবেন, সেখানে কোনও মহিলা চিকিৎসক বা নার্স প্রবেশ করতে পারবেন না। কোনও অনুষ্ঠানে ঢোল বাজবে না। প্রতিটি পুরুষকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে হবে। নইলে তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে ন্যাড়া করে মুখে কালি মাখিয়ে দেওয়া হবে। শিশুদের জেহাদি বানানো হবে। 

ধর্মের নামে এসবই চলবে। জানি না আমরা কতটা এগোচ্ছি এভাবে ! কিন্তু যা হচ্ছে, তা যে ভাল হচ্ছে না, এটা নিশ্চিত। দস্যু সর্দার তালিবানদের নির্দেশে দ্রুততার সঙ্গে মুছে যেতে বসেছে সহজ সরল, অনাড়ম্বর আফগান জনজীবনের রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ। শিকারির মতো কাঁধে ঝোলানো কালাশনিকভ নিয়ে রাস্তা দিয়ে ঘুরছে তালিবানরা। কারও হাতে ছিপছিপে লাঠি। চামড়ার চাবুক। 'বেয়াদব' কোনও নারীকে দেখলেই তাঁর পিঠে ওই চাবুকের দাগ বসিয়ে দিতে উদ্যত দস্যুরা। বলতে গিয়ে চোখে জল চলে আসে রেহমাতুল্লাহর। বলেন, আফগান রমণী চোখ বুঝলেই গুলির শব্দ শুনতে পাবে। ধরফরিয়ে উঠে বন্ধ করে দেবে ঘরের সদর দরজা। সেই দিন কি আবার ফিরে আসছে ? ভুলেও এদের জল্লাদ বলা যাবে না। কালো ফেট্টিতে চোখ ঢাকা এরা 'ধর্মীয় প্রহরী'!‌

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন