সমকালীন প্রতিবেদন : শনিবার ভোর আড়াইটে নাগাদ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে ভিড় জমিয়েছিলেন হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমী। কারণ, বিলাসবহুল পার্সোনাল জেট থেকে তখনই শহরে পা রাখেন লিওনেল মেসি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন লুইস সুয়ারেস ও রদ্রিগো দি পল। তিনদিনের ‘গোট ট্যুর ইন্ডিয়া’র সূচনা কলকাতা থেকেই– খবর ছড়াতেই শহরজুড়ে তৈরি হয়েছিল উৎসবের আবহ।
বিমানবন্দরের বাইরে রাতভর অপেক্ষা করেছিলেন সমর্থকেরা। কেউ আর্জেন্টিনার পতাকা হাতে, কেউ আকাশি-সাদা জার্সিতে, কেউ বা মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে শুধু এক ঝলক দেখার আশায়। তবে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে ব্যাক এন্ট্রি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যান মেসি। অধিকাংশ সমর্থকই তাঁকে চোখে দেখার সুযোগ পাননি। হতাশা থাকলেও তখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। কারণ, সামনে ছিল দিনভর ঘোষিত কর্মসূচি।
সকাল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মব্যস্ততা তীব্র হয়। লেক টাউনের শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবে তৈরি ৭০ ফুটের মেসি মূর্তি হোটেল থেকে ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেন তিনি। কোথাও উল্লাস, কোথাও প্রশ্ন—মাঠে না এসে কেন ভার্চুয়াল উদ্বোধন? তবু পরিস্থিতি তখনও শান্তই ছিল।
এরপর নজর ঘোরে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের দিকে। নির্ধারিত সূচি অনুযায়ী, স্টেডিয়াম ল্যাপ, মঞ্চে উপস্থিতি, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, শাহরুখ খান ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ– সব মিলিয়ে প্রায় দু’ঘণ্টার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। হাজার হাজার দর্শক টিকিট কেটে স্টেডিয়ামে ঢুকেছিলেন, অনেকেরই খরচ হয়েছিল মোটা অঙ্কের টাকা। প্রত্যাশা একটাই– মেসিকে অন্তত একবার সামনে থেকে দেখা।
বেলা ১১টার কিছু পরে মেসি স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন। কিন্তু চারপাশে ঘন নিরাপত্তা বলয় ও ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিদের’ ভিড়ে গ্যালারির বড় অংশ থেকেই তাঁকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী, মাঠে তাঁর উপস্থিতি ছিল প্রায় ২০ মিনিট। নির্ধারিত ল্যাপ সম্পূর্ণ হয়নি, কোনও আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎও হয়নি। আচমকাই তাঁকে স্টেডিয়াম থেকে বের করে নেওয়া হয়। আর সেই মুহূর্তেই বদলে যায় পরিস্থিতি।
প্রথমে গ্যালারি থেকে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পরে মাঠে নামার চেষ্টা, চেয়ার ও বোতল ভাঙা, ব্যানার ছেঁড়া– ক্রমে বিশৃঙ্খলার ছবি স্পষ্ট হয়। নিরাপত্তা বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খায়। শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান ভেস্তে যায়। যে যুবভারতী একসময় ফুটবলের গর্জনে কাঁপত, সেখানে দেখা যায় চরম অরাজকতা।
ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে মেসির কাছে ক্ষমা চান এবং ‘মিসম্যানেজমেন্ট’-এর কথা স্বীকার করেন। তদন্তের ঘোষণাও করা হয়। বিকেলে সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার জানান, ঘটনার দায় মূলত আয়োজকদের। প্রধান আয়োজক শতদ্রু দত্তকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, টিকিট বিক্রি ও স্টেডিয়ামের সক্ষমতার মধ্যে বড়সড় ফারাক ছিল।
এই বিপর্যয়ের মধ্যেও কিছু দৃশ্য আলাদা করে চোখে পড়ে। বিমানবন্দরে এক তরুণীর হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড– ‘ভারতীয় ফুটবলকে বাঁচান’। কয়েক সেকেন্ডের সেই দৃশ্য যেন গোটা দিনের সারকথাই বলে দেয়। মেসির সফর ছিল জৌলুসে ভরা, কিন্তু আয়োজনে রয়ে গেল প্রশ্ন, ক্ষোভ আর তদন্তের প্রতিশ্রুতি। মেসি চলে গেছেন হায়দরাবাদ ও দিল্লির পথে, কিন্তু কলকাতার শনিবার থেকে গেল এক ব্যর্থ আয়োজনের স্মৃতি হয়ে।









কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন