সমকালীন প্রতিবেদন : স্ত্রীকে সুস্থ করতে গিয়ে নিজেই বিছানাবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সেই পরিস্থিতির যে আর বদল ঘটবে না, তা অনেকেই ভাবতে পারেন নি। চেন্নাইয়ে স্ত্রীকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে দীর্ঘ চিকিৎসার পর মধ্যমগ্রামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বনগাঁ হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ তরফদার। সোমবার সকালে তাঁর প্রয়াণে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে বনগাঁ সহ তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, শুভাকাঙ্খীদের মধ্যে। শিক্ষকতা শুধু তাঁর পেশা ছিল না—ছিল একটি দায়বদ্ধতা, একটি নিবেদনের নাম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর।
প্রায় আড়াই মাস আগে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার প্রয়োজনে চেন্নাই যান রবীন্দ্রনাথবাবু। সেখানেই রাস্তা পার হওয়ার সময় এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। মাথায় গুরুতর আঘাত, দেহের একাধিক অস্থি ভেঙে গিয়েছিল। চেন্নাইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চলে। পরিবারের পক্ষে এই চিকিৎসা ব্যয় বহন করাটা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছিল। তবে ঠিক তখনই আশার আলো হয়ে পাশে দাঁড়ান তাঁর বহু প্রাক্তন ছাত্র এবং অন্যান্যরা।
শিক্ষকের সংকটের কথা জানাজানি হতেই একের পর এক প্রাক্তন ছাত্র, সহকর্মী, বন্ধু, শুভাকাঙ্খীরা এগিয়ে আসেন। কেউ আর্থিক সাহায্য পাঠান, কেউ চেন্নাইয়ের হাসপাতালে পৌঁছে রক্ত ও প্লাজমা দান করেন। তাঁদের অকুণ্ঠ সহায়তায় সাময়িকভাবে কিছুটা উন্নতিও হয়। একাধিক জটিল অস্ত্রোপচারের পর তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয় মধ্যমগ্রামে। কিন্তু সংক্রমণ বারবার ফিরে আসছিল। শেষের দিকে তাঁর যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। মেয়ে জানান, শেষ পর্যন্ত আর কষ্ট সহ্য করতে পারছিলেন না তিনি।
অবশেষে রবিবার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে মধ্যমগ্রামের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ তরফদার। সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই শোকাহত বনগাঁ। এদিন দুপুরে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনগাঁ হাই স্কুলে—যেখানে তিনি শিক্ষকতা করেছিলেন দীর্ঘদিন। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শতাধিক প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী এবং স্থানীয় মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জানান। বিশেষ করে স্কুল চত্বরে থাকা এক পুরনো কাঁঠাল গাছের নিচে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁর দেহ—যেখানে একদিন তিনি ছাত্রদের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন বহু মুহূর্ত। যেন জীবনের এক পূর্ণবৃত্ত সম্পূর্ণ হলো।
বনগাঁ হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক দিলীপ ঘোষ বলেন, "চেন্নাইতে যাওয়ার সময় আমাদের কিছু বলেন নি। সেখানে পৌঁছানোর পর গোটা বিষয়টি ফোন করে আমাদের জানান। কিন্তু সেখানে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজেই দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয়ে এভাবে চলে যাবেন, তা ভাবতেও পারি নি। রবীন্দ্রনাথবাবুর মতো শিক্ষক আজকের দিনে বিরল। তাঁর মৃত্যু শিক্ষাক্ষেত্রে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করল।"
স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র দীপাঞ্জয় দত্ত ও অনুপম চক্রবর্তী বলেন, "চেন্নাইতে যাওয়ার পরেও আমরা স্যারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতাম। তাঁর বিশ্বাস ছিল, স্ত্রীকে সুস্থ করে তিনি বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু যে মানুষটা নিজের অসুস্থতা ভুলে স্ত্রীর পাশে দাঁড়াতে গিয়েছিলেন, তিনি নিজেই আর বাড়ি ফিরলেন না—এই বাস্তবতা আমরা মেনে নিতে পারছি না। তাঁর অসুস্থতার কথা শুনে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর বহু ছাত্র, শুভাকাঙ্খীরা সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না।"
রবীন্দ্রনাথ তরফদার এমন একজন শিক্ষক ছিলেন যিনি পাঠ্যবইয়ের গণ্ডি পেরিয়ে জীবনের পাঠ শেখাতেন। তাঁর ব্যবহার, আন্তরিকতা এবং ছাত্রদের প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ তাঁকে সকলের প্রিয় করে তুলেছিল। তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, গোটা সমাজ ও শিক্ষা-জগতের অপূরণীয় ক্ষতি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন