Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫

বাংলাদেশে ক্ষমতা বদলের এক বছর : ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের উত্তরাধিকার ও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

 

Change-of-power-in-Bangladesh

সমকালীন প্রতিবেদন : ২০২৪ সালের জুলাই-অগস্টে ঘটে যাওয়া ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছর পূর্ণ হলো। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসন। ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু এক বছরের মাথায় দেশ এখনো উত্তাল, অনিশ্চয়তার আঁধারে ঢাকা।

গত বছরের জুলাই মাসের শুরুতে কোটা সংস্কার ঘিরে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন দ্রতই রূপ নেয় বৈষম্যবিরোধী বৃহত্তর গণআন্দোলনে। এরই মধ্যে ঘটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ছাত্র-জনতার রাস্তায় নেমে আসা অভ্যুত্থান। মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে, ৫ অগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। সেই দিনটিকে আজ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবেও বিবেচনা করছে।

ক্ষমতা বদলের বর্ষপূর্তিতে রাজধানী ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত ‘৩৬ জুলাই উদ্‌যাপন’ কর্মসূচিতে অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন। এই ২৮ দফার দলিলটি ছাত্র-গণ আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি নিয়ে এসেছে। ইউনূস বলেন, “এই ঘোষণাপত্র ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হবে।”

ঘোষণাপত্রে হাসিনা সরকারের শাসনকে ‘ফ্যাসিবাদী’ ও ‘গণবিরোধী’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ব্রিটিশ শোষণ, পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্র এবং শেখ মুজিব ও এরশাদ আমলের দমন-পীড়নের কথাও স্মরণ করা হয়েছে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের উত্থানকে ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিএনপির প্রতি রাজনৈতিক বার্তাও দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাধিক মামলা চলমান। ইতিমধ্যেই ১৪৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এই মামলাগুলির মধ্যে রয়েছে ছাত্র নেতা সাইদুর রহমান হত্যাকাণ্ড, যেটিকে এই অভ্যুত্থানের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ ভারত সরকারের কাছে হাসিনাকে ফেরানোর অনুরোধ জানালেও, নয়াদিল্লি কোনো 'ইতিবাচক সাড়া' দেয়নি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্র দপ্তর।

মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম দিকে দেশবাসীর মধ্যে আশার সঞ্চার করলেও, এক বছরের মধ্যেই সেই প্রত্যাশায় ভাটার টান স্পষ্ট। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক স্থবিরতা নিয়ে নাগরিক সমাজে অসন্তোষ বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবি তুলেছে। অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তব কোনও রূপরেখা এখনও উপস্থাপন করতে পারেনি।

সরকারবিরোধী অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগকে ২০২৪ সালের অক্টোবরেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, তারা আবারও সংগঠিত হচ্ছে। গোপালগঞ্জে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদেও পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন হাসিনা-সমর্থকেরা। একইসাথে বিভিন্ন এলাকায় জামায়াতের সমর্থকেরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, যার ফলে জাতিগত ও ধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গুজব ছড়িয়েছে যে, সেনাবাহিনী পুনরায় ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করছে। তবে এখনও পর্যন্ত জেনারেল ওয়াকার উজ জামানের নেতৃত্বাধীন বাহিনী অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে রয়েছে। তবে সামরিক নেতৃত্বের ভূমিকায় পরিবর্তন আসলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথচলায় আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকেরা।

বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে ইতিহাস গড়ার প্রত্যয়, অন্যদিকে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান দেশকে একটি নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করালেও, সেই সম্ভাবনাকে সুদৃঢ় করতে হলে দরকার একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রূপরেখা, কার্যকর প্রশাসনিক সংস্কার এবং সকল রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন। জনগণ অপেক্ষা করছে—স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝে একটি সেতুবন্ধন কখন নির্মিত হবে।‌

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন