সমকালীন প্রতিবেদন : এক চরম দুঃস্বপ্নের শেষে অবশেষে পরিবারের কাছে ফিরলেন ফজের মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী তসলিমা মণ্ডল। উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার এই পরিযায়ী শ্রমিক দম্পতিকে বাংলাদেশি সন্দেহে মহারাষ্ট্র পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং পরে ‘পুশব্যাক’ করে পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশে। গত কয়েকদিন ধরে দুশ্চিন্তা, দৌঁড়ঝাঁপ আর প্রশাসনিক লড়াইয়ের পর তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় রাজ্য পুলিশ ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।
বাগদার বাসিন্দা ফজের মণ্ডল পরিযায়ী শ্রমিকের কাজের সূত্রে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গত দু’মাস আগে যান মহারাষ্ট্রে। সেখানে কাজ করার সময় চলতি বছরের ১০ জুন নয়ানগর থানা এলাকায় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের খোঁজে চালানো এক পুলিশি তল্লাশির সময় গ্রেপ্তার করা হয় ওই দম্পতিকে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তাঁরা বাংলাদেশি নাগরিক এবং অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছেন।
গ্রেপ্তারের পর ফজের ও তসলিমা নিজেদের ভারতীয় নাগরিক বলে দাবি করেন এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা এলাকার বাসিন্দা হিসেবে পরিচয়পত্রও পেশ করেন। তাঁদের আধার কার্ড, ভোটার আইডি, রেশন কার্ড-সহ যাবতীয় পরিচয়পত্র পাঠানো হয় বাগদা থানার মাধ্যমে নয়ানগর থানায়। তবুও তাঁদের ছাড়া হয়নি বলে অভিযোগ।
এমনকি অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে, কোনওরকম পূর্ব-সতর্কতা ছাড়াই উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফজের ও তসলিমাকে। তাঁদের রাখা হয়েছিল বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার ভাতুড়ি গ্রামে।
ঘটনার কথা জানতে পেরে চরম আতঙ্ক ও হতাশায় পড়ে যান বাগদার মণ্ডল পরিবার। ফজেরের বাবা তাহাজুল মণ্ডল ও মা লতিফা মণ্ডল রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হন। তাঁদের সহযোগিতায় বাগদা থানার পুলিশ যোগাযোগ করে উত্তর দিনাজপুর পুলিশ ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে।
প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে রবিবার, ১৬ জুন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এবং বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি-র মধ্যে একটি ফ্ল্যাগ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই দেশের যৌথ সিদ্ধান্তে ফজের ও তসলিমাকে পুনরায় ভারতে ফেরানোর অনুমতি দেওয়া হয়।
সেদিন রাতেই ওই দম্পতিকে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতে আনা হয় এবং প্রথমে রাখা হয় ভাটল পুলিশ ফাঁড়িতে। খবর পেয়ে বাগদা থেকে রায়গঞ্জে পৌঁছে যান ফজেরের পরিবারের সদস্যরা। পুলিশের তত্ত্বাবধানে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয় ফজের ও তসলিমাকে।
ছেলে ও বউমাকে ফিরে পেয়ে আবেগে ভেঙে পড়েন তাহাজুল ও লতিফা মণ্ডল। তাহাজুল মণ্ডল জানিয়েছেন, এই ঘটনার পর তিনি আর ছেলেকে ভিনরাজ্যে পাঠাবেন না। এলাকাতেই কোনও না কোনও রোজগারের ব্যবস্থা করবেন। তিনি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, 'প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ না থাকলে হয়তো ছেলেমেয়েকে আর ফিরে পাওয়া যেত না। সরকারের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।'
এই ঘটনায় মহারাষ্ট্র পুলিশের ভূমিকাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্কও। অভিযোগ, প্রমাণ থাকার পরেও মহারাষ্ট্র পুলিশ তাঁদের কথা বিশ্বাস করেনি। আরও ভয়ঙ্কর, কোনও আদালতের নির্দেশ বা পরিপূর্ণ তদন্ত ছাড়াই একজন ভারতীয় নাগরিক দম্পতিকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়—যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।
এই ঘটনা ফের একবার পরিযায়ী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, প্রশাসনিক দায়িত্বজ্ঞান এবং আন্তঃরাজ্য পুলিশ সমন্বয় ব্যবস্থার দুর্বলতা তুলে ধরল। প্রশাসনিক তৎপরতায় এক দম্পতির ফিরে আসা যেমন স্বস্তির খবর, তেমনি ভবিষ্যতে যেন আর কোনও ফজের বা তসলিমাকে এমন যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে না যেতে হয়, সে নিশ্চয়তাও জরুরি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন