Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫

‌ডুয়ার্সের জঙ্গলে তিন মাসের ‘লকডাউন’: বেকারত্ব ও অসুবিধায় পর্যটন শিল্পে জড়িত হাজারো মানুষ

Dooars-Forest

সমকালীন প্রতিবেদন : ডুয়ার্সের জঙ্গল মানেই প্রকৃতির কোলে অজস্র জীববৈচিত্র্য আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার হাতছানি। গরুমারা, নেওরাভ্যালি, চাপরামারি, জলদাপাড়া, বক্সা—এইসব জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক টানতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রতিবছরের মতো এবারও ১৬ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেল ডুয়ার্সের সব জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল। বন দপ্তরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই সময়টি বন্যপ্রাণীদের প্রজননকাল। তাই জীবজগতের স্বাভাবিক জীবনচক্র বজায় রাখতেই এই ‘জঙ্গল লকডাউন’ অত্যন্ত জরুরি।

বনবিভাগের এই সিদ্ধান্ত পরিবেশ ও বন্যপ্রাণ রক্ষার পক্ষে যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনই এর প্রভাব পড়ে স্থানীয় পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির উপর। ডুয়ার্সের প্রতিটি বনাঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় অসংখ্য মানুষ পর্যটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। গাইড, জিপসি চালক, আদিবাসী নৃত্যশিল্পী, হস্তশিল্প বিক্রেতা, হোমস্টে মালিক, ছোট হোটেল ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্থানীয় সবজি বা ফল বিক্রেতাও এই পর্যটনের সঙ্গেই রোজগার জুড়ে রেখেছেন।

এই তিন মাসে বনবাংলোতে রাত্রিযাপন, জিপ সাফারি, হাতির পিঠে জঙ্গল ভ্রমণ—সবই নিষিদ্ধ। ফলে পর্যটক না থাকায় আয় বন্ধ হয়ে যায় এইসব পেশার মানুষের। ট্যাক্স দিয়ে অনুমোদিত জিপ গাড়িগুলি এই সময়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পর্যটকদের অভাবে জিপসি চালক ও গাইডদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। তিন মাস সম্পূর্ণ কর্মহীন হয়ে পড়েন তাঁরা। কেউ কেউ কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে যান, কেউ মজুরির কাজ করেন স্থানীয় এলাকায়। গাইডদের অভিযোগ, পর্যটন মৌসুমে তারা সরকারি নিয়ম মেনেই কর দেন, অথচ এই অফ-সিজনে তাদের জন্য নেই কোনও সরকারি সহায়তা বা বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। ফলে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে।

ডুয়ার্সের জঙ্গল ঘিরে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির অংশ হল আদিবাসী নৃত্য ও গান। বনবাংলো বা ক্যাম্পে রাতের দিকে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য স্থানীয় আদিবাসী নারী-পুরুষ ও শিশুদের নিয়ে গড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক দল। এই দলে রয়েছে ধামসা-মাদলের সুরে গড়ে ওঠা নাচ ও গান। কিন্তু জঙ্গল বন্ধ হওয়ায় এই শিল্পীদেরও কাজ চলে যায়। তাঁরা অধিকাংশই ফরেস্ট ভিলেজারের পরিবারভুক্ত। চা বাগানে কাজ পান না। ফলে বিকল্প কাজ বলতে কেবলই দিনমজুরি, সেটাও সহজলভ্য নয় বর্ষায়।

জঙ্গলের আশেপাশে থাকা ছোট খাবারের দোকান, স্যুভেনির বিক্রেতা, হোমস্টে বা লজের মালিকদের অবস্থাও শোচনীয়। তিন মাস তাদের ব্যবসা একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়। সঞ্চিত অর্থে কোনওরকমে সংসার চালাতে হয়। পর্যটন শিল্পের এমন দীর্ঘ বন্ধে আর্থিক ক্ষতি গড়ে কোটি টাকার উপর ছুঁয়েছে বলে দাবি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।

তবে আশা আছে। জলপাইগুড়ি বন বিভাগের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে রাজ্য বন দপ্তরের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, যাতে অন্তত জঙ্গলের বাইরের কিছু ওয়াচ টাওয়ার এবং বনবাংলো খোলা রাখা যায়। যেমন—কালিকাপুর, ধূপঝোরা, পানঝোরা, হর্নবিল ক্যাম্প ও চুকচুকি ওয়াচ টাওয়ারগুলিকে পর্যটকদের জন্য খোলা রাখার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এতে কিছুটা হলেও পর্যটন চলমান থাকবে বলে তাঁদের আশা।

বন দপ্তর জানিয়েছে, আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে আবার খুলে যাবে সব জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তখন থেকেই ফের শুরু হবে জিপ সাফারি, হাতির পিঠে জঙ্গল ভ্রমণ, রাত্রিকালীন বনবাংলোয় থাকা—সবকিছুই। তবে এই তিন মাসের ব্যবধানে কতটা আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি হল, কতজন পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হল—সে হিসাব করা কঠিন। এই সময় জঙ্গল যেমন বিশ্রামে যায়, তেমনই বিশ্রামে যেতে হয় হাজারো মানুষের রুজি-রোজগারকেও।‌





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন