Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৩

বাঙালির উৎসব এবং বাঙালিত্ব



Bengali-festival

বাঙালির উৎসব এবং বাঙালিত্ব

পীযূষ হালদার

পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। এটা বাঙালিয়ানার একটা বিরাট উৎসব। সময়ের কারণে উষ্ণ আবহাওয়ায় নববর্ষ উৎসব উদযাপন কষ্টকর হলেও আম বাঙালির কাছে আদরের দিন। এক সময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের সময়। হায়ন শব্দের অর্থ বছর বা সন। সে কারণেই অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ আক্ষরিকভাবে বছরের সূচনা। অগ্র মানে শ্রেষ্ঠ। যে সময়ে শ্রেষ্ঠ ধান মেলে তখনই অগ্রহায়ণ। বাংলা কৃষি প্রধান দেশ। তাই এক সময়ে বাংলার উৎসবের মাস অগ্রহায়ণ। নববর্ষও ছিল এই অগ্রহায়ণ মাসে। 

বাংলা কৃষি প্রধান দেশ হলেও, কৃষিকে আশ্রয় করেও চিরকাল চলেনি বাংলার অর্থনীতি। বিদেশি এবং এদেশীয় বণিকেরা একসময় খুব প্রতিপত্তি অর্জন করে। সেই ধাক্কায় অগ্রহায়ণ মাসে আর নববর্ষ রইল না। অনেক আগে থেকেই বৈশাখ অবশ্য ভারতবর্ষের অনেক প্রদেশের নববর্ষের সূচক ছিল। 

বৈশাখ মাসে নববর্ষের সূচনা হিসেবে ধরার হিসেবনিকেশ মুঘল সম্রাট আকবরের অনেকটা ভূমিকা ছিল। চন্দ্রমাস এবং সৌর মাসের যে গরম মিল থাকার জন্য তার পক্ষে কর আদায় অসুবিধা হচ্ছিল। তাই সেই সময় থেকেই বৈশাখ মাসকেই নববর্ষের মাস হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। পহেলা বৈশাখী তাই নববর্ষ উদযাপনের দিন। 

বাঙালির নিজেকে নিয়ে অহংকারের মাত্রা খুব তীব্র। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। গর্ব করার কারণও আছে। বহু মনীষী এবং দিকপালের জন্ম এই বাংলায়। তারা দেশ এবং দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তর ছাপ রেখেছেন। সেই কারণেই বাঙালির বাঙালিআনা বা বাঙালিত্বের গর্ব অক্ষুন্ন রাখতে কিছু চিহ্ন, কিছু সূচকের প্রয়োজন হয়। এই সূচকের একদিকে যেমন নাম আছে রবীন্দ্রনাথ,  বিবেকানন্দ, নেতাজির, অন্যদিকে আছে বেশ কিছু উৎসব। পয়লা বৈশাখ, ২৫ বৈশাখ, দুর্গোৎসব, সরস্বতী পুজো। 

সেই সব সুচকের প্রথমেই পরিলক্ষিত হয় সৃষ্টিশীল বলে বিবেচিত হন এমন কিছু যুবক–যুবতীর মধ্যে। রাতারাতি পায়জামা–পাঞ্জাবি বেরিয়ে পড়ে সারা বছরের জন্য আটকে রাখা আলমারির মধ্যে থেকে। বাঙালি যুবতীদের জন্য আলমারি থেকে বেরোবে মায়ের চন্দনরঙা লালপাড় গরদের শাড়ি। তারপরেই পুরুষ ও মহিলারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন রাস্তায়। শুরু হবে উৎসব। কিছু বাংলা কবিতা বলা হবে। সঙ্গে থাকবে কিছু গান, কিছু কথা। হয়ত জনসমক্ষে এমন কিছু জায়গা নির্বাচন করা হবে, যেখানে বসে তাদের সৃষ্টির বিস্তার করা যাবে। 

আবার একটা নববর্ষ। পয়লা বৈশাখ। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, পাড়ার দোকানগুলিতে হালখাতার আয়োজন। তার রূপ অলংকার ভূষণ ছিল আলাদা। আম পাতা আর আমের গুটিতে একটা নতুনের আগমনের গন্ধ পাওয়া যেত। নতুন বাংলা ক্যালেন্ডারের ছবিগুলি থাকতো বড় আকর্ষণীয়। বাবা, কাকাদের হাত ধরে দোকানে দোকানে হালখাতার আমন্ত্রণ রক্ষা করার আনন্দ বিংশ শতকেই শেষ হয়ে গিয়েছে। এবারেও হচ্ছে পয়লা বৈশাখের আয়োজন। রাস্তার পাশে বড় শপিংমলে বিক্রেতাদের বাঙালি সাজের ক্লেশকর মুখগুলোকে। যে মুখের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে শুকনো ঠাট্টা। একই অবস্থা দেখা যাবে টিভি চ্যানেলগুলির সঞ্চালিকাদের মধ্যে। 

বাঙালি সংস্কৃতির একটা বড় দিক হল বাঙালির হেঁশেল। কচুর শাক, কচুর লতি। শুক্তো, ঘন্ট, ছক্কা, চচ্চড়ি, ডালনা, লাবড়ায় জমজমাট থাকত। উৎসবের নিয়ম অনুযায়ী এসবের এক এক ধরনের পদের পরিবেশন হতো বাঙালির পাতে পাতে। সারা বছর মা–জ্যেঠিদের ইচ্ছে অনুসারে সময়োপযোগী এসব পদের আয়োজন থাকত বাঙালির পাতে। আজকাল বাঙালির শুক্তো, পাতুরি খেতে যেতে হয় রেস্তোরাঁয়। পাটিসাপটা, মালপো আসে মিষ্টির দোকান থেকে। 

তাই বলে কি আমাদের বর্ষবরণ, আমাদের শারদোৎসব, আমাদের রবীন্দ্র–নজরুল সন্ধ্যা হারিয়ে গিয়েছে। হয়তো সেই অর্থে এখনও হারিয়ে যায়নি। বরং আড়ম্বর বেড়েছে, জৌলুশ বেড়েছে। তবে কোথাও গিয়ে যেন একটু মনে হয়, আমাদের ভেতরকার সংযোগটা শিথিল হয়েছে। বাংলাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বাংলার আবহমানের জলহাওয়াকে আমরা মাঝে মাঝে অস্বীকার করে ফেলছি! 

আমাদের যৌবনকালের থেকে এই সময়ের উৎসব পালন একটা প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে এনে দিয়েছে। কিন্তু বাঙালির উৎসব, বাঙালিত্বকে কি এভাবে পরিমাপ করা যায়! আজকে যদি পয়লা বৈশাখের আনন্দ-উৎসব হয়, তাহলে তা রাষ্ট্রের সীমায় বন্ধ থাকতে পারেনা। অন্যান্য ভাষার দাপট অন্য প্রদেশের সাংস্কৃতিক উৎসব রুখতে বঙ্গ সংস্কৃতির এত চকচকে আর উচ্ছল আয়োজনের দরকার হয় না। 

বাঙালির আত্মাই হল ব্লটিং পেপারের মতো। নিজের শিকড়কে বিসর্জন না দিয়েই বাঙালি গ্রহণ করেছে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা, শব্দ এবং দর্শন। বাঙালি তার শব্দ ভান্ডারে যুক্ত করেছে ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, আরবি, ফারসি, তিব্বতি ইত্যাদি শব্দ। তাতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধই হয়েছে। 

জ্ঞানচর্চার জগতেও তাই সামগ্রিকভাবে বঙ্গসংস্কৃতির অঙ্গই ছিল এক থেকে সমুহে নিজের ভাবনাকে বিস্তারিত করা। উনবিংশ শতকের শেষ ভাগ এবং বিংশ শতকের বেশিরভাগ সময় বাঙালি এই সমুহকে গ্রহণ করেছে। তাই বাঙালি সৃষ্টিশীল মানুষের প্রীতি আজও সারা দেশ-বিদেশে অক্ষুণ্ণ আছে। এখন তাদের পুজোর ছলে, আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই। 

বাংলা কেবল রাজনৈতিক নেতাদের তৈরি করা বাংলা নামক আজগুবি বিষয় নয়। বাংলা দীর্ঘ চর্চার বিষয়। জনজীবনে বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে না হলেও ব্যাপক ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই বাংলা ভাষা বাঁচবে, বাংলা সংস্কৃতি বাঁচবে। বছরের একদিন বাঙালিত্ব জাহির করার ব্যাপার নয় এটা। 



                   ‌

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন