Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

বৃহস্পতিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

গ্রাম-শহরের বাবুদের দুর্গোৎসব – পর্ব ১

Durgotsava-of-Village-Town-Babu–Part-1

গ্রাম-শহরের বাবুদের দুর্গোৎসব – পর্ব ১ 

পীযূষ হালদার‌      

হুতোম থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককালের গবেষক ও লেখকেরা বাংলার দুর্গোৎসবের ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেক জানা-অজানা তথ্য প্রকাশ করেছেন। সেকালের তুলনায় একালের হয়তো দুর্গোৎসবে আড়ম্বরের আতিশয্য বেশি। গ্রাম ও শহরের উৎসবের এই পার্থক্য যুগের প্রয়োজনে পরিবর্তিত হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গ্রাম বাংলার বনেদিবাড়ির সেকালের দুর্গোৎসবের কিছু খণ্ড চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি। 

এই পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায়, বাংলায় সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা হয় হাওড়ার আন্দুলে, ১৫৭০ সালে দত্তচৌধুরীদের বাড়ীতে। আন্দুলের রাজবাড়িতে দুর্গা মন্দির ছিল। এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত প্রতিমায় যেমন নিত্য পুজো হতো, ঠিক তেমনি আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে ধুমধাম করে অকালবোধন পুজো শুরু হতো। চলতো পাঁচ দিন মহা ধুমধামে সেই পুজো। ১৬০৩ সাল থেকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের তহশীলদার ভবনীপ্রসাদ নিজ বাড়িতে দুর্গামন্দির প্রতিষ্ঠা করে পুজো শুরু করেন। 

উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগাঁ মহকুমাতেও অনেক পুরনো পুজোর সন্ধান পাওয়া যায়। সুরেশ্বর নামে এক ব্যক্তি ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের কাছ থেকে 'রাজা'‌ খেতাব পান। তার বংশের সন্তোষ রায় বৈরামপুরের নিজের বাড়িতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন প্রায় ৪০০ বছর আগে। এই সময় থেকেই সেই মন্দিরে প্রতিবছর শরৎকালে অকাল বোধন দুর্গাপূজা শুরু হয়। 

এই জেলার বনগাঁর দত্তপাড়ায় যশোরের রাজা সীতারামের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সূর্যনারায়ণ দত্ত যশোর থেকে এসে বসবাস শুরু করেন। ১৮২০ সাল থেকে সূর্যনারায়ণ দত্তের পৌত্র স্বরূপ নারায়ন দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। সে সময়ে দুর্গাপূজার পাঁচ দিনই এখানে পুজোর প্রসাদ বিতরণ এবং অতিথি আপ্যায়ন চলতো। 

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে গোপালচন্দ্র সিংহ বনগাঁ মুস্তাফিপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে গোপালচন্দ্র বরদাকান্ত সিংহের উদ্যোগে শুরু হয় এই বাড়িতে দুর্গাপুজো। সেই সময় বাড়ির সামনে পাঁচ দিন ধরেই মেলা বসতো। 

রঘুরাম সিদ্ধান্তবাগীশ ছিলেন নদীয়ার রাজা রুদ্র রায়ের গুরুদেব। এই বংশের পন্ডিত রামভদ্র ন্যায়লঙ্কার ছিলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের গুরুদেব। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গঙ্গার ধারে বাহিরগাছি গ্রামে গুরুদেবের জন্য নির্মাণ করে দেন বসবাসের ঘর, দরদালান, ১২ টি শিবমন্দির এবং একটি সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। 

রামভদ্র ন্যায়লঙ্কার এই পরিবারে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। এই বংশের সন্তান মধুসূদন তর্কপঞ্চানন। মধুসূদনের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের বন্ধুত্ব। ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর মহাশয় নদীয়া জেলার স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। নৌকোয় গুড়গুড়ি নদী পেরিয়ে পৌঁছালেন বাহিরগাছি গ্রামে। সেখানে গিয়ে দেখলেন মধুসূদন  অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। 

মহাষ্টমী পুজোর লগ্ন প্রায় শেষ। লোকমুখে শোনা যায়, এই পুজোয় তিনি একদিনের জন্য পুরোহিত হয়েছিলেন। অষ্টমীর দিন মায়ের ভোগে দেওয়া হয় ইলিশ মাছ। জল ছাড়া কেবল সরষের তেলে আস্ত মাছ ভেজে সেই 'তেলমাছ' ভোগ দেওয়া হয়। lo

বর্গী হামলার ভয়ে চৌধুরী পরিবার মুর্শিদাবাদ থেকে বর্ধমানের আমাদপুরে ১৭৯৩ সালে চলে আসেন। শোনা যায়, ১৮৯৭ সালে এই পরিবারের পুজোয় শিবনাথ শাস্ত্রী এবং কালীপ্রসন্ন সিংহ এসেছিলেন। এখানে ১৯ দিন ধরে পালিত হয় দুর্গাপুজো। দেবী দুর্গার একচালা মূর্তি। লক্ষ্মী-সরস্বতী কোনও বাহন নেই। 

হুগলির জনাই-এর কাছে বাকসা গ্রাম। এখানে রয়েছে বাকসা সিংহ বাড়ি। মহাভারত এবং হুতম পেঁচার নকশা রচয়িতা কালীপ্রসন্ন সিংহ ছিলেন এই বংশের সন্তান। বাকসার বাড়িতে মহেন্দ্রনাথ সিংহ দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। এই বাড়িতে প্রতিমার কাঠামো পুজো হতো জন্মাষ্টমীর দিন। 

হাওড়া আমতার নারিট গ্রামের ভট্টাচার্য্য পরিবারের দুর্গাপুজো প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন। এই পুজোর প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল– বাঁদিকে গণেশ, সরস্বতী আর ডানদিকে কার্তিক, লক্ষ্মী থাকে। গণেশ এর পরিবর্তে কার্তিকের পাশে থাকে কলাবউ। 

বীরভূম জেলার ইলামবাজারের আউসগ্রামের কালিকাপুরের জমিদার বাড়ির পুজো প্রায় ৩৫০ বছর অতিক্রম করল। এই বাড়িতে মহালয়ার ১৫ দিন আগে থেকে দেবীর আবাহন শুরু হতো। প্রতিদিনই আরতী এবং চণ্ডীপাঠ হতো। আগে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিনই ছাগ বলি হতো।

হুগলি জেলার বলাগড়ে অবস্থিত পাটুলি গ্রাম। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে এই গ্রামে বৌদ্ধ মঠ এবং টোল স্থাপন করেছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। এখানে রাজার অনুমতিক্রমে বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। সেই আমলের সবচেয়ে প্রাচীন এই পুজোতে দেবী দুর্গাকে 'বুড়িমা' বলা হয়। বর্ধমানের কলসারার ঘোষাল বাড়ির পুজোর বয়স প্রায় ৪০০ বছর। এই পরিবারের ১১ তম বংশধর দিগম্বর ঘোষাল ছিলেন সম্রাট শেরশাহের কর্মচারী। শোনা যায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে ঘোষাল পরিবারের দুর্গাপূজা শুরু হয়। 

গ্রাম বাংলার প্রাচীন বনেদি দুর্গাপূজা পর্যালোচনা করতে গিয়ে এটুকু বোঝা যায়, কোথাও কোথাও সাধারণ গ্রামবাসীরাও অংশগ্রহণ করতে পারতেন। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এইরকম বহু প্রাচীন গ্রাম্য মেলার সন্ধান পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে আনন্দ–উল্লাসের প্রকাশ পাওয়া যেত মেলা, যাত্রা থিয়েটারে। 


*ঋণী—কিছু দৈনিক সংবাদপত্র এবং সর্বাণী মুখোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধ। 

    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন