Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

শনিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২১

TOUR : কোচবিহারের রাজবাড়ি, মদনমোহন মন্দির ও রাস পূর্ণিমার মেলা

The-palace-of-Kochbihar

        কোচবিহার রাজবাড়ি, মদনমোহন, রাস মেলা              

অজয় মজুমদার

উত্তরবঙ্গের অন্যতম দ্রষ্টব্যস্থান কোচবিহার রাজবাড়ি। এখানে একটা নৃতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা রয়েছে। বিকেল ৫ টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য সেটি খোলা থাকে। কোচবিহারের কোচ রাজাদের রাজত্বকালের সমাজের চালচিত্র সেখানে সংগৃহীত রয়েছে। ওই রাজত্বে যেসব উপজাতি বসবাস করতো, তারমধ্যে অন্যতম রাজবংশী। রাজবংশী কথার অর্থ রাজার বংশধর। ঐতিহাসিক পটভূমিতে এরা কোচবিহারের রাজপরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত। রাজবংশীরা দেশী এবং রাজবংশী ক্ষত্রিয় নামেও পরিচিত৷ উত্তরবঙ্গে রাজবংশীরা একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী৷ এরা কৃষিজীবী এবং অনেকেই কৃষি জমির মালিক৷ রাজবংশীরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের মধ্যে অন্য ধর্মের প্রভাবও দেখা যায়৷ এদের মাছ ধরার সরঞ্জাম থেকে শুরু করে বসবাস রীতি সবই কোচবিহার রাজবাড়ির মিউজিয়ামে রাখা আছে। লৌকিক দেবদেবীর চিত্রও এই সংগ্রহশালায় রয়েছে। তারা যেসব গয়না পরিধান করতো, সে সবকিছুর নিদর্শনও এখানে রয়েছে। 

The-palace-of-Kochbihar

টোটোরাও উত্তরবঙ্গের আর একটি ছোট্ট উপজাতি গোষ্ঠী৷ জলপাইগুড়ি জেলার ভুটান সীমান্তে টোটোপাড়ায় এদের বাস৷ পূর্বে এরা কমলালেবুর বাগানে কাজ করতো৷ বর্তমানে এরা সুপারি চাষ করে৷ এটিই এদের নগদ পয়সার উৎস৷ এরা সামান্য পরিমাণে কাউনি, মারুয়া ও ভুট্টার চাষ করে৷ টোটোরা বিশ্বাস করে, ব্যক্তির অস্তিত্ব মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গেই শেষ হয়ে যায় না৷ তাই মৃত্যুর ব্যবহৃত যাবতীয় জামা-কাপড়, গয়নাগাঁটি, বাসন ইত্যাদি মৃতদেহের সঙ্গে কবরে দিয়ে দেয়। এরা প্রকৃতির পূজারী। ভুত-প্রেত অশুভ আত্মার অস্তিত্বেও এরা বিশ্বাস করে। এদের ঘরবাড়ি এবং চাষবাসের রীতির নিদর্শন এই সংগ্রহশালায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ 


গোর্খা বা গুর্খা বা নেপালি সামগ্রিকভাবে নেপালি বংশোদ্ভূত। এই জনগোষ্ঠী অতীতে মূলত নেপাল থেকে ভারতে আসে৷ এদের সর্বাধিক বসবাস দার্জিলিং জেলায় হলেও দেশের অন্যান্য স্থানে অল্প সংখ্যায় এদের দেখা যায়৷ এদের মাতৃভাষা নেপালি৷ এদের জীবিকা মূলত কৃষিভিত্তিক৷ তাছাড়া, সরকারি-বেসরকারি অফিসেও বর্তমানে এরা সিকিউরিটির কাজ করে৷ সমাজে এদের স্তরবিন্যাস খুবই স্পষ্ট এরা বেশিরভাগই হিন্দু এবং কেউ কেউ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী৷ আর একটি জনগোষ্ঠী রাভা। এরা জলপাইগুড়ি, কোচবিহার অঞ্চলে বসবাস করে৷ রাভা কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সমতলের রাভা এবং অরন্যের রাভা। সমতলের রাভারা কৃষিনির্ভর৷ আর অরণ্যের রাভারা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক নিয়োজিত শ্রমিকের কাজ করে৷ একসময় রাভারা ছিল মাতৃ কৌলিক৷ বর্তমানে পিতার কুল পরিচয়েই সন্তানের পরিচয় দেওয়া হয়। রাভারা বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীর পুজো করেন৷ তারা ভুত-প্রেত ও নানা অশুভ আত্মার অস্তিত্বেও বিশ্বাস করে৷


লেপচারা দার্জিলিংয়ের খুব প্রাচীন আদিবাসী৷ এরা নিজেদের কাঞ্চনজঙ্ঘার সন্তান বলে পরিচয় দেয়৷ তাদের মূল পেশা ছিল মূলত পাহাড়ে ঝুম চাষ। এখন অনেকেই স্থায়ীভাবে ফল চাষ করে৷ বাকিরা সবাই অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত৷ এদের নিজস্ব ভাষা, লিপি এবং অভিধান আছে৷ এরা প্রকৃতির পুজো করে৷ মেচ উপজাতির মানুষেরা দার্জিলিং এর কিছু অংশে, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার গহন অরণ্য এবং খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর তীরে তাদের বসবাসের স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ মেচরা স্থায়ী কৃষিজীবী। এদের মেয়েরা বয়ন শিল্পে বিশেষ পারদর্শীতার পরিচয় দেয়। যে মেচ সমাজে একদা মায়ের কুল পরিচয়ে ব্যক্তির পরিচয় দেওয়া হতো। সে সমাজ আজ সম্পূর্ণ রূপে পিতৃ কৌলিক৷ অনেকেই হিন্দু ধর্মালম্বী৷ তারা কিছু লৌকিক দেবতার পুজো করে৷ এই জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছেন। 


ভুটিয়ারা দার্জিলিং জেলায় বসবাস করে৷ পূর্বে এদের জীবিকা ছিল ব্যবসা। তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্য পথ বন্ধ হওয়ার পর ভুটিয়ারা কৃষিকে নতুন জীবিকা হিসাবে বেছে নেয়৷ এরা সবাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী৷ লামা মুখোশ নৃত্য এদের ধর্মীয় সংস্কৃতির একটি অঙ্গ৷ কোচবিহারের কোচ রাজাদের শাসনকালে অস্ত্রের বিবর্তনের মডেলগুলি মিউজিয়ামে সাজানো রয়েছে৷ মুলত বন্দুকের বিবর্তন। রয়েছে জীবন-জীবিকার বিভিন্ন সরঞ্জাম৷ মাছ ধরার উপকরণ থেকে চাষবাসের সরঞ্জাম৷ রয়েছে লৌকিক দেবদেবীর মূর্তি৷ সমগ্র রাজবাড়িটি ভারত সরকারের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে। রাজবাড়ির সঙ্গেই রয়েছে মদনমোহন মন্দির। এই মন্দিরের রাস উৎসব বিখ্যাত। কোচবিহারের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছেন কোচ রাজাদের কুল দেবতা মদন মোহন দেব। রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ তৈরি করেছিলেন এই মন্দির৷ ট্রাস্ট সূত্রেই জানা গেছে, কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়নের আমলে ১৮৯০ সালে বৈরাগী দিঘিরপাড়ে মদনমোহন মন্দির তৈরি হয়৷ ওই বছরের ২১ মার্চ রাজাদের কুলদেবতা মদনমোহন বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। 


বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ৷ পুজোর আমেজ কাটতে না কাটতে শুরু হয় রাস। আর এই রাস  উদযাপনে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গের মানুষের আগ্রহ যেন একটু বেশি। এর কারণ অবশ্যই কোচবিহারের মদনমোহন৷ কোচবিহারের রাসমেলা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশজুড়ে বিখ্যাত। প্রতি বছর মদনমোহন মন্দিরে রাস উৎসব দেখতে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা৷ অনেকে মনে করেন, মদনমোহনকে মনেপ্রাণে পুজো করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়৷ শোনা যায়, ১৯১১ সালে রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সময়কালে অসম থেকে এখানে এসেছিলেন বৈষ্ণব গুরু শংকরদেব৷ বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করতে এসে তিনি বলেন, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধারানী বলে কিছু হয় না| আসলে একই সঙ্গে তার দুই রূপ। এই ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছে কোচবিহারের মদনমোহন বিগ্রহ৷ একসময় রাসচক্র ঘুরিয়ে রাজারা রাস মেলার সূচনা করতেন৷ এখন রাজার পরিবর্তে মন্দিরের ট্রাস্টি এবং জেলাশাসক এই রাসচক্র ঘুরিয়ে মেলার সূচনা করেন৷ অতীতে এই মেলা চলতো একমাস ধরে। এখন তা কমে ১৫–২০ দিন হয়েছে। 

The-palace-of-Kochbihar


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন