Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১

গোপাল ভাঁড় : ইতিহাস নাকি কল্পনা ?

 

Gopal Bhar : History or fiction?

স্বপন ঘোষ : নদীয়াধিপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বিদূষক গোপাল ভাঁড়ের গল্প পড়তে বা শুনতে বাঙালি যতটা আগ্রহী অথবা গোপাল ভাঁড়ের গল্প নিয়ে ব্যবসা করতে বাংলা প্রকাশনা জগৎ যতটা উৎসুক, গোপাল চরিত্রটির সত্যাসত্য অনুসন্ধানে বাঙালি বা বাংলা প্রকাশকরা ততটা আগ্রহী নন। গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে মাতামাতি চলছে কমবেশি ৩০০ বছর। অথচ হাস্যরসের মধ্যমণি এই মানুষটি সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা। সাংবাদিক সুজিত বসু গোপাল ভাঁড়কে নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে লিখেছেন 'গোপাল ভাঁড়ের সন্ধানে'‌ নামে একটি বই। নানা তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে তিনি দেখিয়েছেন যে গোপাল একটি ঐতিহাসিক চরিত্র। অনেকেই যেমন না জেনেই জোরালো সওয়াল করেন, গোপাল ভাঁড় নামে আসলে কেউ ছিলেন না, সবটাই কাল্পনিক ! সুজিতবাবুর এই প্রচেষ্টার পর আশা করা যায় এসব বন্ধ হবে।


 গোপাল ভাঁড় সম্পর্কে আকর গ্রন্থ হল নগেন্দ্রনাথ দাসের লেখা 'নবদ্বীপ কাহিনী বা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপাল ভাঁড়'। নগেন্দ্রনাথ আসলে গোপাল ভাঁড়ের বংশধর। গ্রন্থটিতে তিনি সুস্পষ্ট লিখেছেন, গোপাল ভাঁড়ের পূর্বপুরুষ আনন্দরাম নাই এর বসতি ছিল মুর্শিদাবাদে। জাতিতে নাপিত এই মানুষটি নবাব আলিবর্দী খাঁ এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরে তিনি জায়গিরদার হন। তাঁর ছেলে দুলালচাঁদ নবাবের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হয়েছিলেন। নবাবের নাতি সিরাজউদ্দৌল্লাকে তিনি একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন। দুলালচাঁদের দুই পুত্র‌– কল্যাণ ও গোপাল। নগেন্দ্রনাথের দাবি মতো তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, গোপাল ভাঁড় আদতে মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা।


নদীয়াধিপতি মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সমসাময়িক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের প্রপিতামহ আরেক কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তাঁকে আলিবর্দী খাঁ হুগলির খানাকুলে জায়গির দিয়েছিলেন। গোপালের পরিবার একসময় খানাকুলে কৃষ্ণচন্দ্রের অধীনে কর্মরত ছিলেন। দুই কৃষ্ণচন্দ্রের মধ্যেও একসময় গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয় এবং কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র অনেকবারই খানাকুলে গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি একসময় বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ গোপালকে দেখেন এবং তাঁকে নিয়ে আসেন কৃষ্ণনগরে। কালক্রমে গোপাল হন মহারাজের সভার হাস্যার্ণব এবং পঞ্চরত্নের অন্যতম। তাঁর মেধাশক্তি ও হাস্যরসের জন্য মহারাজ গোপালকে রাজভাণ্ডারের প্রধান হিসাবেও নিয়োগ করেন এবং তিনি গোপাল ভাণ্ডারী নামে পরিচিত হন। ভাণ্ডারী থেকেই অপভ্রংশ হয় ভাঁড়। 

গোপাল ভাঁড় চরিত্র নিয়ে আজগুবি গল্পের মূলে রয়েছে বাঙালির অসচেতনতা। টেলিভিশন সিরিয়ালে গোপাল ভাঁড়ের নাম ব্যবহার করে সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং অসহ্য গল্প খাঁড়া করার বিরুদ্ধে, আর কলেজস্ট্রীট পাড়ার ঠিকানা-গোত্রহীন প্রকাশকদের ছ্যাবলামোর বিরুদ্ধে বাঙালির কাঙ্খিত প্রতিবাদ দেখা যায় না। কলেজস্ট্রীট পাড়ায় গোপাল ভাঁড়, বীরবল, মোল্লা নাসিরউদ্দীন, মোল্লা দোপেঁয়াজা ইত্যাদি সবাইকে একসঙ্গে করে সাড়ে বত্রিশ ভাজা বিক্রির ব্যবস্থা করা হয় মাঠে–ঘাটে–ট্রেনে– ফুটপাতে–পানবিড়ির দোকানে। 

আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করতে পারিনা, ধরে রাখতে পারিনা। তাই গোপাল ভাঁড় আমাদের কাছে শুধুই 'ভাঁড়', স্থূলত্বের প্রতীক। বিদেশি গবেষকদের চোখে কিন্তু গোপাল তত 'সস্তা' নন। বিদেশি ভাষায় লেখা গোপাল ভাঁড়ের গল্পের সংকলন দেখলেই এই বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়।‌

1 টি মন্তব্য: