Breaking

Post Top Ad

Your Ad Spot

মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৩

শিকড় ছেড়া মানুষগুলোর মনস্তত্ত্ব



The-psychology-of-uprooted-people

শিকড় ছেড়া মানুষগুলোর মনস্তত্ত্ব 

পীযূষ হালদার

আজ থেকে ৭৬ বছর আগের এই দিনটিতেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। আমরা এবার ৭৭ তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি। সেটা যেমন আনন্দের, তেমনই স্বাধীনতা লাভের মধ্যে দিয়েই দুই নতুন রাষ্ট্রের কিছু মানুষের জীবনে দুর্বিষহ দিন নেমে এসেছিল। সেদিনের কথা তাদের মন থেকে আজও মিলিয়ে যায়নি। রিফিউজি বা উদ্বাস্তু। তাদের সেই অমলিন কথা কিছু কিছু জানাব। 

বিষয়টা আমার দেখা নয়। সবই জানা। আমার দাদুর কাছ থেকে। আর দাদুর বক্ষে ধরে আনা সে সময়কার কিছু সংবাদপত্র থেকে। রাজনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের চাপে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের আগমন ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। ধাপগুলি হল– ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯, ১৯৫০ থেকে ১৯৫২, ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ (‌এই সময়ে পাসপোর্ট প্রথা চালু হয়)।    

১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ এই প্রথম পর্যায়ে যারা দেশত্যাগ করেছেন, তারা ছিলেন সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষ। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকের পর কলকাতা, নোয়াখালীতে ব্যাপক দাঙ্গাবাধে। এই দুই জায়গাতেই বড় বড় জমিদার, বড় বড় ব্যবসাদারদের বসবাস ছিল। নোয়াখালীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ছিল ১৮ শতাংশ।। কিন্তু জমির মালিক ছিল ৭৫ শতাংশের। কলকাতায় বসবাসকারী মুসলমানরা অনেকেই ছিলেন শিল্পপতি। ঢাকায় বসবাসকারী হিন্দু শিল্পপতিরা কলকাতায় বসবাসকারী শিল্পপতিদের সাথে সম্পত্তি হস্তান্তর বা বিনিময় করেছিলেন। এই পর্যায়ে আগত উদ্বাস্তুরা সম্ভ্রান্ত নায়েব, ডাক্তার, মোক্তার, সম্পন্ন ব্যবসায়ী শ্রেণীর। 

উদ্বাস্তু আগমনের দ্বিতীয় ধাপ ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়। ৫০ এর জানুয়ারি থেকে পূর্ববঙ্গের খুলনা, ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী, বরিশাল সহ বিভিন্ন জায়গায় পুনরায় গোলমাল শুরু হয়। এই সময়ে দেশত্যাগের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে এদেশে উদ্বাস্তু আগমনের সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও প্রায় ৭০ হাজার জন উদ্বাস্তু আসেন পশ্চিমবঙ্গে। এই সময়ের মধ্যে সমাজের বিশিষ্টজনদের দ্বারা বেসরকারি উদ্যোগে দুই বঙ্গের মধ্যে হিন্দু মুসলমান জনবিনিময়ের একটা চেষ্টা হয়েছিল। 

কিন্তু জহরলাল নেহেরু ছিলেন এর ঘোরতর বিরোধী। তাই তখন সম্ভব হয়নি। ৫১ সালে পূর্ববঙ্গে ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা দেয়। সরকারি ব্যবস্থা থাকলেও হিন্দু জনগণ তা থেকে বঞ্চিত হয়। তাই কিছু নিম্নবর্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পূর্ববঙ্গ ছাড়তে বাধ্য হন। পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর জনজাতি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের অধিকাংশই ছিলেন প্রান্তিক চাষী। চাষবাস নির্ভর গ্রামীন জীবন ত্যাগ করে তারা দেশান্তরী হওয়ার সাহস পাননি। 

তৃতীয় পর্যায়ের উদ্বাস্ত আগমন ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল। আইনসভায় পাকিস্তান সরকার দুটি আইন পাস করে। ১৯৫৪ সালের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী সরকারের অনুমতি ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে না। হিন্দুদের সম্পত্তি বিক্রি করার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি পেতে নানারকম ঝামেলা পোহাতে হয়। ফলে সেই সময় অনেকেই জমি জায়গা ফেলে দেশত্যাগ করেন। 

চতুর্থ ধাপে দেশত্যাগ শুরু হয় ১৯৬১ সাল থেকে। এই সময়ে ৬২ থেকে ৬৪ সালে খুলনা, বরিশাল,  ফরিদপুরের নানা জায়গায় গোলমাল শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে প্রায় একই সময়ে গোলমাল বাধে। এই সময়ে উভয় দেশের হিন্দু–মুসলমান সম্প্রদায়ের বেশ কিছু মানুষ দেশত্যাগ করে। ১৯৬৫ সালে ইস্ট পাকিস্তান এনিমি প্রোপার্টি অ্যাক্ট চালু হয়। এরপরে হাজার হাজার একর জমি বাড়ি দখল হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বরকত ও শফিকুউজ্জামানের একটি সমীক্ষায় বলা হয়, 'শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের দরুন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কুড়ি লক্ষ একরের বেশি জমি হারাতে হয়েছে।'‌  

১৯৬১ থেকে ৬৫ এর মধ্যে ১০ লক্ষ উদ্বাস্তু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। এরপর আর এক দফায় ১৯৭১ সালের হাঙ্গামায় যে সমস্ত হিন্দু মুসলমান উদ্বাস্তু এদেশে এসেছিল, তাদের মধ্যে অনেক হিন্দু উদ্বাস্তু আর দেশে ফেরেনি। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এভাবেই উদ্বাস্তু আগমন ঘটেছিল। পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুরা দীর্ঘ সময় ধরে সীমানা অতিক্রম করেছে, তা এখনও চলছে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক সমস্ত দিক থেকে রিক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিটে ত্যাগ তাদের সবকিছুকে উলটপালট করে দিয়েছে। 

১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট এর হিন্দুস্থান  স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয় এক কলমে—  

 '১৫ আগস্ট, ১৯৪৭-এ ভারতের স্বাধীনতা একটি সুখী বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। আনন্দের মাঝে তরুণ দুই ডোমিনিয়ন ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতার তিক্ত ফল প্রত্যক্ষ করা হয়েছে গুরুতর অশান্তিতে, যেখান থেকে উদ্বাস্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে। পাঞ্জাবের ব্যাপক অভিবাসন প্রায় ৫.‌৫ মিলিয়ন লোককে অশান্ত করে।'‌ ( বঙ্গানুবাদ) 

       --- হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডারড, ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭  

পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে উদ্বাস্তুদের যথাযথ পরিচয় এর সম্পত্তির তথ্য জানবার নির্দেশ দেওয়া হয় ১৯৫০ সালে। ২২ এপ্রিলের সত্যযুগ পত্রিকায় এই নির্দেশনামা দেখতে পাই। 

সুরাহা আজও হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন প্রদেশের গভীরে গ্রাম–শহরে কত অভিবাসী বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন, তা আজও আমরা জানতে পারিনি। শিকড় ছাড়া মানুষগুলোর অনেকেই আজকে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। এদেশে এসে মহিরুহের মতো মাটির গভীরে শিকড় পৌঁছাতে পারেননি। সামান্য তৃণের মতো মাটির উপরেই ভাসিয়ে রেখেছে তার শিকড়। দুর্যোগ দুর্বিপাকে ধ্বংস হয়। হঠাৎ খরা, বন্যায় মাটির উপরে বেঁচে থাকা তৃণগুলো যেমন ধ্বংস হয়।  

ঋণী— 

১/ উদ্বাস্তু ইতিহাস ও আখ্যান, আশিস হিরা ।

২/ স্বাধীনতার সময়ের কিছু সংবাদপত্র। 

               

                   ‌

1 টি মন্তব্য: